আমরা সবাই আল্লাহর বান্দা; আল্লাহর গোলাম। তাঁর ইবাদতের জন্যই তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তার প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত অসংখ্য নেয়ামতের সাগরে ভাসছে আমাদের জীবন। এ বাস্তবতা মেনেই আমাদের তাঁর ইবাদতে সক্রিয় হতে হবে। রাব্বি কারিমের সন্তুষ্টি অর্জনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতি মুহূর্তে তাঁর আদেশ মেনে চলা এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এগারোটি মাসের কর্মব্যস্ত জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন পালনে শিথিলতা আসতেই পারে। তাই একটি মাস রাখা হয়েছে সেই শিথিলতা ও দুর্বলতা কাটিয়ে ইবাদতের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। মাসটি রমজান মাস। এ মাসেই রয়েছে একটি বিশেষ আমল যা পুরো মাসের এমনকি পুরো জীবনের ধর্মীয় বন্ধনকে অটুট করে বাকি জীবনের সঞ্জীবনী শক্তি জোগায়। এ মাসেই নবীজি (সা.) নবুওয়াত ও রিসালাত পেয়েছেন।
এ মাসের শেষ দশকের একটি বিজোড় রাত, যে রাতে তাঁর ওপর সব বাণীর সেরা বাণী কোরআন নাজিল হয়েছে। এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ (বরকতময় রাত) ও ‘লাইলাতুল কাদর’ (সম্মানিত রাত)। এ রাতের গুরুত্ব বুঝে আসে যখন দেখি ‘আল কাদর’ নামে ছোট অথচ একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা নাজিল হয়। এতে বলা হয়েছে ‘হাজার মাসের (অসংখ্য) চেয়েও এ রাত উত্তম।
জিবরিল আমিনের নেতৃত্বে ফেরেশতারা তাদের রাব্বির নির্দেশে সন্ধ্যা থেকেই নেমে আসে পৃথিবীতে। ঘুরে বেড়ায় বিশ্বময়। ফজর (সুবেহ সাদিক) পর্যন্ত ইবাদতকারীদের ওপর তারা সালাম পেশ করতে থাকেন।’ (সুরা আল কাদর)। লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকে হওয়ায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনগুলোতে মসজিদে এতেকাফ করতেন যেন নিশ্চিত এ রাতটি পাওয়া যায়। যেন বঞ্চিত না হন এ রাতের মর্যাদা ও বরকত থেকে।
এতেকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে যে কোনো মসজিদে অবস্থান করা। স্বল্প সময়ের জন্যও বছরের যে কোনো সময় দিনে-রাতে এতেকাফ করা যায়। যেমন সালাত হোক বা অন্য কোনো আমলের জন্য যতক্ষণ মসজিদে এতেকাফের নিয়তে অবস্থান করা হবে ততক্ষণ এ সময়টা এতেকাফ হিসেবে গণ্য হবে। তবে তা রমজানের এতেকাফের তুল্য অবশ্যই হবে না।
রমজানের এতেকাফ দু’ধরনের।
এক. সুন্নত। একে সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়াও বলা হয়। শেষ দশ দিন একান্তভাবে ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করা। এ ক্ষেত্রে এতেকাফের শর্তাবলী ও মাসাইল জেনে নিতে হবে। সামান্য ভুলে এই এতেকাফ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। তখন আবার এর কাজাও করতে হয়। মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে কেউ একজন এতেকাফ করলে অন্যরা এর দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
দুই. নফল। প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সুযোগ রেখে যে ক’দিন সম্ভব এতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এ ক্ষেত্রে সুন্নত এতেকাফের শর্তাবলী প্রযোজ্য হবে না।
এতেকাফের মূল লক্ষ্য লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এ রাত তালাশ করতে আমি প্রথম দশ দিন এতেকাফ করি, এরপর মাঝের দশ দিন, এরপর আমাকে এ রাত দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে এ রাত শেষের দশকে রয়েছে।
অতএব তোমাদের যারা এতেকাফে আগ্রহী তারা যেন এ সময় এতেকাফ করে। তার সঙ্গে লোকেরা এতেকাফ করেন। (মুসলিম : ১১৬৭)। অন্য হাদিসে বর্ণিত যে, ‘রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিতে তোমরা লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি : ২০১৭)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমৃত্যু রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন। তারপর তাঁর স্ত্রীরা এতেকাফ করতেন। (বুখারি : ২০২৬)। আল্লাহ এতেকাফকারীদের প্রশংসা করেছেন কোরআনে কারিমে। (সুরা বাকারাহ : ১২৫)। এতেকাফে বসে আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি মেলে, আমরা যেন এতেকাফে বসার চেষ্টা করি।