পাটবীজ উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল ৫ বছরে বাংলাদেশ

দেশের মানসম্মত ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে পাটবীজ উৎপাদনে পাঁচবছরের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে সরকার। আগামীতে সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ উন্নত পাটবীজ উৎপাদনে ২০২৫ সালের মধ্যে স্বনির্ভর হবে। থাকবে না আর আমদানি নির্ভরতা। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ছলতি বছর ২০২১ সাল থেকে। ধাপে ধাপে তা আগামী পাঁচবছরে শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।

ভারত থেকে জেআরও-৫২৪ জাতের পাটবীজ আমদানি করা হয়। এটিই তোষাপাট নামে পরিচিত। এর বিকল্প হিসেবে গত ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) তোষা -৮ (রবি-১) নামে পাটের একটি নতুন জাত অবমুক্ত করেছে। এটি ভারতীয় তোষা জাতের পাটের চেয়েও উন্নত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন জাত বলে কৃষকরা ভরসা রাখতে পারছে না দেশে উদ্ভাবিত নতুন তোষা-৮ জাতের পাট ও তার বীজের উপর। তারা আমদানিকৃত ভারতের জেআর-৫২৪ জাতের পাট চাষেই আগ্রহী বেশি। আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভারতীয় জেআর-৫২৪ জাতের পাটের তুলনায় দেশে উদ্ভাবিত তোষা-৮ বা রবি-১ নামের পাটচাষে কৃষকদের লাভবান করতেই মূলত ৫ বছরের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

দেশে বর্তমানে দেশে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দেশি, ও তোষা এই দুই জাতের পাট চাষ করা হয়। তবে কেনাফ ও মেসতা জাতের পাটও বাংলাদেশে চাষ করা হয়, যার মান ততটা উন্নত নয়। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৭৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশে এই পরিমাণ পাট উৎপাদনে পাটবীজের প্রয়োজন ৬ থেকে ৭ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পাটবীজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। এর মধ্যে তোষাপাট উন্নত জাতের হওয়ায় এর চাহিদা ব্যাপক। যা জেআর-৫২৪ জাতের পাট নামে পরিচিত।

পাটচাষিরা জানায় , আমরা তো ভারতীয় বীজের বিকল্প অন্য কোনও বীজ লাগাইনি। নতুন বীজ রোপণ করে ঝুঁকি নিতে চাই না, যদি ফসল মার খায়? এ কারণেই ভারতীয় বীজের প্রতি আগ্রহ বেশি। নতুন জাতের রবি-১ বীজটি এখনও সেভাবে কৃষকদের মাঝে পৌঁছাতে পারেনি সরকার। এই বীজের প্রতি আস্থা আসতে কিছুটা সময় লাগবে।

দেশের কৃষকরাই এক সময় দেশি পাটের বীজ উৎপাদন করতো। সাধারণত কৃষকরা ক্ষেতের একাংশ পাট বীজ উৎপাদনের জন্য রাখতো। এ পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহে সময় লাগে ১০ থেকে ১১ মাস। এই সমস্যা সমাধানে বিজেআরআই ‘নাবী পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তির’ মাধ্যমে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর—মাত্র এই চার মাসে উন্নত মানের বীজ উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু এই সময়ে মাঠে বেশি দামের রবিশস্য চাষ না করে পাটচাষে আগ্রহী হয় না কৃষক।

এ আশঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসতেই অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। এর ফলেই তোষা-৮ বা রবি-১ নামের পাটের জাত উদ্ভাবন করেছে বিজেআরআই। বিজেআরআই বলেছে, এতে কৃষকরাই লাভবান হবেন।

পাটবীজ উৎপাদনের মৌলিক ধাপ তিনটি। এগুলো হচ্ছে- ১. ভিত্তি বীজ । ২. প্রজনন বীজ ও ৩. প্রত্যায়িত বীজ। বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে, ১. প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত শতভাগ কৌলিত্বাত্তিক দিক থেকে বিশুদ্ধ বীজকেই প্রজনন বীজ নামে পরিচিত। ২. প্রজনন বীজকে বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় ভিত্তি বীজ। সরাসরি বা গবেষণা খামারে গবেষক বা কৃষিতত্ত্ববিদ এবং বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে এই বীজ উৎপাদন করা হয়। আর ৩. ভিত্তিবীজ বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় প্রত্যায়িত বীজ। এই বীজই কৃষকদের মাঝে চাষের জন্য বিতরণ করা হয়। বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সি এই বীজের সনদ প্রদান করে।

পাট বীজ উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ ৫ বছর মেয়াদি যে রোডম্যাপ তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে—প্রথম বছর ২০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। এর জন্য পাট উৎপাদন এলাকায় ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।

দ্বিতীয় বছর ৪০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। এ দিয়ে ১ হাজার ৪৬৪ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইভাবে এ ক্ষেত্রেও নিবিড় পাট উৎপাদন এলাকায় ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষিদের কাছে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।

আরো পড়ুন- গরম বাতাসে ৩ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত

তৃতীয় বছর বাড়িয়ে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে যা দিয়ে ২ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইভাবে ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ একই পদ্ধতিতে পাটচাষিদের বিতরণ করা হবে। প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।

রোডম্যাপ অনুযায়ী চতুর্থ বছর একইভাবে বিজেআরআই’র সরবরাহ করা প্রজনন বীজের মাধ্যমে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ৪ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে সরকার। যা বিনামূল্যে নয়, ভর্তুকি মূল্যে প্রতিকেজি বীজের মূল্য ১০০ টাকা দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে। এ ক্ষেত্রেও ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে।

রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বশেষ পঞ্চম বছর আরও ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় চার হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে। এটিও ভর্তুকি মূল্যে ১০০ টাকা কেজি দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে।

বর্তমানে ভারত থেকে পাট বীজ রফতানিতে ভারত সরকারের কোনও নেগেটিভ সিদ্ধান্ত নেই।