কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের মাধ্যমেই দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব

ড. এফ এইচ আনসারী। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এগ্রি বিজনেসের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিত্ব ড. আনসারী ৩৫ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বীজ, সার, ক্রপ কেয়ার, ফার্ম মেকানাইজেশন, এনিমেল হেলথ এবং সমন্বিত পোলট্রিসহ এগ্রি বিজনেসের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছেন। গত ২২ বছর ধরে এসিআই গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করছেন ড. এফ এইচ আনসারী। কৃষি উন্নয়ন নিয়ে দেশ সমাচারের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। কথা বলেছেন কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে। বলেছেন শুধুমাত্র তৈরি পোশাক এবং রেমিটেন্স দিয়েই হবেনা, কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের মাধ্যমেই দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।

দেশ সমাচার : আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের গুরুত্ব কেমন?

ড. এফ এইচ আনসারী : ২০০০ সালে যেখানে খামারে ৬০ শতাংশ মানুষ কাজ করতো সেখানে এখন ৪০ শতাংশ মানুষ কাজ করে। ২০৩০ সালে এটি ২৭ শতাংশে নেমে আসবে। কৃষকের বয়স, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংসহ নানান সংকট থাকলেও কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। একারনেই কৃষির আধুনিকরণ করতে হবে। কৃষির আধুনিকরণ করলে আমাদের তরুণরা কৃষিতে আগ্রহ পাবে। পাশাপাশি যন্ত্রের ব্যবহারের কারনে উৎপাদনও বাড়বে এবং কৃষির প্রতি মানুষের অনীহা থাকবেনা।

দেশ সমাচার : কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জন্য আমাদের সংকট কোথায়?

ড. এফ এইচ আনসারী : কৃষির যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশের মতো ভারতেও চ্যালেঞ্জ আছে। তবে আমাদের দেশে যান্ত্রিকীকরণের হার বেশ ভালো। কৃষির নানান ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ আছে। আমাদের জমি ছোট ছোট, কৃষক এসব যন্ত্র কিনে ব্যবহার করলে খুব একটা লাভবান হবেনা, কৃষি উদ্যোক্তারা এসব যন্ত্র কিনে সার্ভিস প্রোভাইড করে লাভবান হচ্ছেন। এসব উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়নের প্রয়োজন।সরকারের উদ্যোগে কৃষি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন করা হলে এর মাধ্যমে কৃষি উদ্যোক্তাদের ফান্ড এবং প্রশিক্ষণ দেয়া যাবে এবং এ খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা কম মূল্যে সেবা পাবেন অন্যদিকে একটা উদ্যোক্তা গ্রুপ তৈরি হবে।

দেশ সমাচার : দেশে কৃষি নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে তা পর্যাপ্ত ?

ড. এফ এইচ আনসারী : আমাদের দেশে সরকারি বেসরকারিভাবে যেসব গবেষণা হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। এসব গবেষণার ফলাফলগুলোও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। উন্নত কৃষির জন্য ভালো গবেষণা প্রয়োজন এবং ডাটা দরকার। বেসরকারি পর্যায়ে এবং সরকারি পর্যায়ে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এবং বাস্তবসম্মত গবেষণা করতে হবে।

দেশ সমাচার : নতুন জাতের ধানে গড় ফলন না বাড়ার কারণ কি?

ড. এফ এইচ আনসারী : বিআর ৮৯ জাতের ধান আট টন পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব। এমন উৎপাদন হলে বর্তমান যে জমি আছে তার অর্ধেকে চাষাবাদ করলে চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা যায়। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে না কারন একেক কৃষক একেক রকম উৎপাদন করতে পারছেন। এর কারন হচ্ছে গবেষনা লব্দ জাতের ধানটি সঠিক ভাবে চাষাবাদ না করা। দেশে প্রায় ২৫ হাজারের বেশী কৃষি এক্সটেনশন শ্রমিক আছে এবং বেসরকারি পর্যায়ে লক্ষাধিক এক্সটেনশন শ্রমিক আছে এদের নতুন টুল দিতে হবে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম দিতে হবে। এতে ডিলার, কৃষক এবং এক্সটেনশন ওয়ার্কার কানেকটেড হলে একই তথ্য সবাই পাবে। এতে উৎপাদন বাড়বে এবং ইল্ড গ্যাপ আস্তে আস্তে কমে আসবে।

দেশ সমাচার : কৃষকদের ‍কৃষি শিক্ষায় ফসলির অবদান কেমন?

ড. এফ এইচ আনসারী : ফসলি এ্যাপসে কৃষির নানা তথ্যের সমন্বয় করা হয়েছে। সার, বিজ, কিটনাশকের ব্যবহার বিধি, ইরিগেশান, যান্ত্রিকীকরণের যাবতীয় তথ্য, হাস মুগরী পালন, দুধ উৎপাদন, মাছ চাষসহ কৃষির প্রায় প্রতিটি বিয়য়ই এ্যাপসটিতে রাখা হয়েছে। কয়েকটি এ্যাপস নিয়ে কাজ করছে এসিআই। ফসলি ফসলের জন্য, সোনালী এ্যাপ করা হয়েছে পোলট্রির জন্য , রুপালী মাছের জন্য এবং খামারী এ্যাপস তৈরি করা হয়েছে দুধ এবং মাংশের জন্য। এসব এ্যাপ যারা ব্যবহার করবে তারা সঠিক তথ্য পাবে। এ্যাপটি ব্যাবহার করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা কৃষি সম্পর্কিত যে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে। এ্যাপটির মাধ্যমে প্রাপ্ত কৃষি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরও দেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশ সমাচার : আলু উৎপাদন, রপ্তানি এবং সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাই।

ড. এফ এইচ আনসারী : আমনের পর জমি খালি থাকে তাই কৃষকরা বাড়তি লাভের জন্য আলু উৎপাদন করে। সরকারের পলিসি পরিবর্তনের কারনে এখন দেশে প্রায় ৪০ টি জাতের আলু উৎপাদন হয়, এর মধ্যে এসিআই এর ১৩ টি জাত আছে। আলু রপ্তানির চেয়ে দেশে আলুর প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানী করলে বেশী লাভবান হওয়া সম্ভব। বিদেশ থেকে চিপস, ফ্রেন্স ফ্রাই আমদানী না করে দেশীয় ভাবে উৎপাদন করতে পারলে লাভবান হওয়া যাবে। সাউথ এশিয়ায় ফ্রেন্স ফ্রাই এর বেশ চাহিদা আছে, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এ। আলু রপ্তানী করতে হলে প্রক্রিয়াজাত করে আলুর প্লেক, স্টাচ বানিয়ে রপ্তানী করা উচিত। তাজা আলু রপ্তানী না করে এভাবে চিন্তা করলে আরো বেশী লাভবান হওয়া সম্ভব।

দেশ সমাচার : প্রতি বছর পেঁয়াজের সংকট তৈরি হয়, এই সংকট সমাধানে করনীয় কি?

ড. এফ এইচ আনসারী : দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৪৫ লক্ষ মেট্রিক টন কিন্তু উৎপাদন হয় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। ঘাটতি প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। ইনভারমেন্টাল হাউজে পেঁয়াজ সংরক্ষন করলে হয়তো সংকট তেমন হতো না। কিন্তু বছরের শেষের দিকে এসে গ্রীস্ম ও বর্ষার শেষ চার মাসে পেঁয়াজের সংকট হয়, তখন দাম বেড়ে যায়, পেঁয়াজ আমদানী করতে হয়। এতো বছর পেঁয়াজের স্থানীর ভালো জাত ছিলোনা, আমরাই প্রথম এমন একটি জাত নিয়ে এসেছি যেটি সারা বছর উৎপাদন করা যায়। বর্ষা কিংবা গ্রীস্ম কালে আমাদের উদ্ভাবিত পেঁয়াজের জাত বিপ্লব উৎপাদন করা যায়  এবং এই পেঁয়াজের ইল্ড প্রায় ৩০ টন অন্যদিকে দেশে যে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় তার ইল্ড ১০ থেকে ১৪ টন। আমরা যদি ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে এ পেঁয়াজ আবাদ করতে পারি তবে ১০ থেকে ১২ লক্ষ টন পেঁয়াজ হয়ে যায়। সার্বিকভাবে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত এ পেঁয়াজ উৎপাদনে। গ্রীস্মকালে পেঁয়াজের আবাদ বাড়াতে হবে। কৃষি এক্সটেনশনকে কাজ করতে হবে।

দেশ সমাচার : ড. এফ এইচ আনসারীর ব্র্যান্ডিং ট্যাগ লাইন ”কৃষককে সমৃদ্ধশালী করতে হবে” এই শ্লোগানটি কেনো সবসময় ব্যবহার করেন?

ড. এফ এইচ আনসারী : কৃষি এবং কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে কৃষি। কৃষিকে বাদ দিয়ে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অর্ধেক মানুষ কৃষির সাথে জড়িত, এসব মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পেলে সামগ্রিক অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের ভোক্তাদের সাথে কৃষকের সরবরাহ চেইন সংযোগের মাধ্যমে কৃষিতে জিডিপির উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। ফলে দেশে দরিদ্রতা হ্রাসের পাশাপাশি জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। শুধুমাত্র তৈরি পোশাক এবং রেমিটেন্স দিয়েই হবেনা, কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নের মাধ্যমেই দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি।

দেশ সমাচার : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. এফ এইচ আনসারী : দেশ সমাচারকেও অনেক ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন