গর্ভাবস্থায় বিশেষ যত্ন সম্পর্কে আজকাল সবাই বেশ সচেতন হয়ে উঠছেন। গর্ভধারণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন।প্রতিষেধক ও সাপ্লিমেন্ট নেওয়া তো বটেই; গর্ভে সন্তান আসার পরেও নিয়মিত চেকআপে গিয়ে শিশুর অবস্থা যাচাই করা, মা ও সন্তানের যথাযথ পুষ্টি, পরিমিত বিশ্রাম, ব্যায়াম, মানসিক যত্ন নিশ্চিত করা। কিন্তু আনন্দ, উৎকণ্ঠায় ঘেরা এই সময়টায় এত সব চেকআপের মাঝে কেউ কেউ মুখ ও দাঁতের চেকআপটা করিয়ে নিতে বেমালুম ভুলে যান।
এই চেকআপ করালে কী লাভ ক্ষতি?
গর্ভাবস্থায় মুখে সচরাচর কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মুখে কোনও রোগ সৃষ্টির জন্যে গর্ভধারণ সরাসরি দায়ী নয়। বরং এ সময় যেসব স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে, সেগুলোই মুখে কিছু সমস্যার উদ্ভব ঘটায় কিংবা পুরাতন সমস্যার উপসর্গকে বাড়িয়ে তোলে! যেমন-
আরোও জানুন- অতিরিক্ত পরিষ্কার থাকলে কি হয় ?
আরোও জানুন- মুখের দুর্গন্ধ দূর করার সহজ দুই উপায়!
দাঁত ক্ষয়:
গর্ভাবস্থায় দাঁত ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ-
১) দাঁত ব্রাশ করার সময় বমি ভাব হওয়ার কারণে কেউ কেউ প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করতে চান না। অনেকে আবার এ সময় শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক ধকলে অতিমাত্রায় ক্লান্তি বোধ করার কারণে মুখ ও দাঁতের যত্নে অবহেলা করে বসেন।
এতে মাড়ির প্রদাহ প্রবণতা বেড়ে যায়।
২) সকালে বমি হলে তার সাথে পাকস্থলীর অ্যাসিড মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার ফলে দাঁতের বহিরাবরণ (এনামেল) ক্ষয় (erosion) হতে পারে।
আরোও জানুন- বিপদের কারণ হতে পারে ঠান্ডা পানি পানের অভ্যাস
মাড়ির প্রদাহ:
গর্ভাবস্থায় হরমোন নিঃসরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এর মধ্যে বিশেষত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের প্রভাবে মাড়ি থেকে রক্ত বেরোনো, ফুলে যাওয়া, মাড়ি ব্যথা, দাঁত শিরশির- এ ধরণের উপসর্গ দেখা দেওয়া খুবই কমন। এছাড়া গর্ভধারণের আগে যদি মাড়িতে প্রদাহ থাকে তাহলে গর্ভাবস্থার ২য় মাস থেকেই তা তীব্রতর রূপ নিতে থাকে!
আরোও জানুন- যে বদঅভ্যাস গুলো মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর
Pregnancy epulis, pregnancy granuloma:
এগুলো সাধারণত দুই দাঁতের মাঝ বরাবর মাড়িতে লাল বর্ণের, নরম পিণ্ড হিসেবে দেখা দিতে পারে। সাধারণত সন্তান জন্মদানের পর এগুলো নিজে থেকে সেরে যায়। না সারলে সার্জিক্যাল চিকিৎসার মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।
দাঁত নড়ে যাওয়া:
হরমোন নিঃসরণে ব্যাপক তারতম্যের প্রভাব পড়তে পারে চোয়ালের হাড়ের মিনারেলস ও পেরিওডন্টাল লিগামেন্টের ওপর। যার ফলে দাঁত সাময়িকভাবে নড়বড়ে মনে হতে পারে।
লালা নিঃসরণ বেড়ে যাওয়া:
এ সময় মুখে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে লালা নিঃসরণ হচ্ছে বলে মনে হতে পারে, বিশেষত বমি বমি ভাব হওয়ার মুহূর্তে।
আরোও জানুন- চুল নিয়ে যত ভুল
আস্বাদনে সমস্যা:
গর্ভাবস্থায় কারও কারও মুখ তেতো মনে হতে পারে। মিষ্টি স্বাদ বুঝতে পারি না, মুখে ধাতব মুদ্রা (coin) নিলে যেমন লাগবে সেরকম স্বাদ পাই- এমন অভিযোগও থাকতে পারে। তবে এটি সাময়িক, সন্তান প্রসবের পর এটি নিজে থেকেই সেরে যায়।
চোয়ালের জয়েন্টে সমস্যা:
গর্ভকালীন বা প্রসবোত্তর মানসিক চাপের কারণে কারও কারও চোয়ালের পেশী বা জয়েন্টে (temporomandibular joint) সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মুখ ও দাঁতের চেকআপ এক্ষেত্রে কীভাবে উপকারী হতে পারে?
আমরা জানলাম যে, মাড়িতে আগে থেকেই প্রদাহ থেকে থাকলে গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে তা প্রকট আকার ধারণ করে। তাহলে কেউ যদি আগেই এর চিকিৎসা করিয়ে নেন, তাহলে গর্ভবতী অবস্থায় এই প্রদাহজনিত ভোগান্তি অনেক কম হবে বলে আশা করা যায়।
আরো পড়ুন- গলাব্যথা সারানোর উপায়
কিছু ঔষধ গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। আবার কিছু ঔষধ মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে চলে যেতে পারে বিধায় স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্যেও ঔষধ সেবনে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে।
ধরুন কোনও গর্ভবতী নারীর একটি আক্কেল দাঁত বাঁকা হয়ে আংশিক উঠে বেকায়দা অবস্থানে আটকে আছে। সার্জারি করে দাঁত তুলে ফেলাই যার সমাধান। কিন্তু দাঁতটি তেমন সমস্যা করেনি বলে ডাক্তারকেও কখনও দেখানো হয়নি। এখন, গর্ভবতী অবস্থায় যদি হঠাৎ এতে তীব্র ব্যথা শুরু হয়, তিনি ব্যথানাশক নিতেও পারবেন না, আবার শরীরের এই নাজুক অবস্থায় হয়তো একটি স্ট্রেসফুল সার্জারির মধ্য দিয়েও যেতে চাইবেন না। তাহলে উপায়?
এমন পরিস্থিতি এড়াতে হলে তাই গর্ভধারণে ইচ্ছুক মহিলাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাগুলো আগেভাগেই সেরে ফেলা ভাল।
মায়ের মুখের স্বাস্থ্য সন্তানের ভবিষ্যৎ সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন- মায়ের periodontitis থাকলে শরীরে এমন কিছু inflammatory mediators release হয়, যার ফলে শিশুর pre term birth এবং low birth weight নিয়ে জন্মানোর ঝুঁকি বাড়তে পারে। আবার মায়ের দাঁতে caries থাকলে সন্তানেরও caries হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর জন্ম এবং তার রোগমুক্ত দাঁত নিশ্চিত করতে মায়েরও মুখের যত্ন জরুরী।
শুধু গর্ভধারণের আগেই নয়, গর্ভকালীন সময়েও নিয়মিতভাবে মুখ ও দাঁতের চেকআপ করানো উচিত। এতে করে এ সময়ে মুখে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, তার প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং পরামর্শ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি শিশুর জন্মের পর থেকেই কীভাবে তার মুখের যত্ন নিতে হবে, সেই সম্পর্কেও জেনে নেওয়া যাবে।
অন্তঃসত্ত্বা এবং প্রসবোত্তর অবস্থায় মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকাটা বিশেষভাবে জরুরী। কল্পনা করুন তো, প্রতিনিয়ত যে মুখ দিয়ে কথা বলছেন, খাবার খাচ্ছেন, সেই মুখে সারাক্ষণ কোনও ব্যথা বা রোগযন্ত্রণা বয়ে নিয়ে কি মন-মেজাজ আদৌ প্রফুল্ল রাখা সম্ভব? কখনোই না। তাই অন্তত প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলোতে ভুগে যেন কষ্ট পেতে না হয়, সেই চেষ্টাটা আমাদের থাকা উচিত।
জেনে রাখা ভাল, ঐচ্ছিক দন্ত চিকিৎসাগুলো গর্ভাবস্থায় না করিয়ে আগে বা পরে করাতে বলা হলেও, এ সময় “বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করে” “অতি জরুরী” কিছু দন্তচিকিৎসা করানো সম্ভব, বিশেষত দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে।
শেষে দু‘টি গুরুত্বপূর্ণ কথা:
(১) মুখ ও দাঁতের চেক আপের আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নেবেন আপনার চিকিৎসক ন্যুনতম BDS ডিগ্রিধারী এবং BMDC কর্তৃক রেজিস্টার্ড ডেন্টাল সার্জন কিনা।
(২) ডেন্টাল সার্জনকে আপনার গর্ভাবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত করবেন।