করোনায় এবারের হজ

হজের প্রস্ত্ততি
ফাইল ছবি

এবারের হজ হবে সীমিত আকারে । শুধু হজ পালন করতে পারবেন সৌদি আরবে অবস্থানকারীরা ।

রাসূল সা: বলেন, ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়াত, অর্থাৎ সব আমলই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে অনেকেই এবার হজ থেকে মাহরুম। আল্লাহ পাক আমাদের অন্তরের সবকিছু শুনছেন এবং দেখছেন। আমাদের নিয়ত হলো যে আমার রব আল্লাহকে রাজি এবং খুশি করা।

আরো পড়ুন- ভোরের আলোয় রংধনুর রঙে ফুটে ওঠে যে মসজিদে

হজ করার পর হাজীদের মহান রাব্বুল আলামিনের ভয়ে তাকওয়ার জ্ঞান আসে। বায়তুল্লাহ তাওয়াফের কারণে আল্লাহ হাজীদের রহমতের চাদরে পরিবেষ্টিত করে তোলেন। হজের দ্বারা বান্দা আল্লাহর কাছে জান এবং মাল নিয়ে সাদা কাপড় পরে আত্মসমর্পণ করেন, মহান রবের মেহমান হওয়ার পূর্ণাঙ্গ সুযোগ লাভ করেন। আল্লাহর ঘর এবং রাসূল সা:-এর রওজা মোবারক তাওয়াফ শেষে বান্দা দুনিয়াবিমুখ হয়ে যায়। অনেকেই নিয়ত করেন যে, পৃথিবীর সব ঝামেলা, ঝড়-ঝঞ্ঝামুক্ত হয়ে হজব্রত পালন করা চাই। কেননা হজের আনুষ্ঠানিকতা বান্দার মাঝে বিশাল আমানতের জিম্মাদারি তৈরি করে। ফলে হাজীরা হজপূর্ব অবস্থার চেয়ে প্রকৃত মুমিন হিসেবে পরহেজগারি নিয়ে চলতে সক্ষম হন। ওই কারণে অনেক সময় জীবন-ভাটির সন্ধিক্ষণে অনেকেই হজ করতে চান, যাতে করে হজ থেকে ফিরে এসে জগত-সংসার অর্থাৎ দুনিয়াবিমুখ হয়ে যেতে পারেন।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে মূল হলো ঈমান তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই)। সালাত ও রমজান হলো দৈহিক ইবাদত। জাকাত হলো অর্থনৈতিক ইবাদত। আর হজ হলো দৈহিক ও আর্থিক ইবাদাত। হজের মাধ্যমে মুমিনদের দেহের পাপগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, মানুষ গোসল করলে যেমন শরীরের ময়লা আবর্জনাগুলো দূর হয়ে যায়। তেমনি হজ করলে মানবজাতির পাপাচারগুলো মুছে যায়। পাপ মানুষকে জাহান্নামের উপযুক্ত করে তোলে, কিন্তু হজ মানবজাতির অতীতের সব পাপকে মুছে দেয়। তাই হজে মাবরুর (মাকবুল হজ) শেষে সব হাজীর ইহজগতের সব দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

হজে যাওয়ার আগে একজন হজযাত্রী রাফাছ অর্থাৎ অশ্লীলতা বা পাপাচার এবং জিদাল বা ফিৎনা ফাসাদ থেকে মুক্ত থেকে তাকওয়া অর্জনের অনুশীলন করবে। কবুল হজের জন্য যেমন তাকওয়া বা খোদাভীতি অপরিহার্য, তেমনি একজন সফল ও সার্থক হাজীর, হজ-পরবর্তী জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক হওয়া অপরিহার্য। হাজী উপাধিধারী ব্যক্তির আল কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ২০৩-২০৬)

রাসূল সা: এরশাদ করেন, হজ শেষে হাজীগণ নিষ্পাপ-মাসুম শিশুর মতো হয়ে যান। হাজী নিজে সিবগাতাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর রঙে রঙিন হয়ে যান। আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিণত হয়, যা মৃত্যু পর্যন্ত কখনো মুছে যায় না। হজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, আরাফাতে অবস্থান, তাওয়াফে জিয়ারাহসহ রাসূল সা:-এর স্মৃতিবিজড়িত পূত-পবিত্র স্থানগুলো প্রত্যক্ষ করার ফলে হাজীদের চিন্তাচেতনা, চরিত্র ও কর্ম এবং জীবন বৈশিষ্ট্য ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়ে যায়।

আরো পড়ুন- সব রোগের দাওয়াই সূরা ফাতেহা

শয়তানকে পাথর মারার পর হাজীর অন্তরে তাবৎ শয়তানি শক্তি দূর হয়।
রাসূল সা:কে জনৈক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: গোনাহ বা পাপের রঙ কী রকম? রাসূল সা: উত্তরে বললেন, গোনাহ বা পাপের রঙ হলো কালো, কেননা হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথরটি) ভিত্তি প্রস্তরকালীন সময় হাজরে আবইয়াজ (সাদা পাথর) ছিল। ওই ‘সাদা পাথর’ মানুষের গোনাহগুলো চুম্বকের মতো চুষতে চুষতে কালো হয়ে যায়। আর মানবজাতি গোনাহমুক্ত হয়ে আল্লাহর জমিনে প্রত্যাবর্তন করে।

হজ পরবর্তী সময়ে সব হাজীর তাকওয়াভিত্তিক জীবন একমাত্র পাথেয়। অনেকে হজ থেকে ফিরে এসে হালাল-হারাম যাচাই-বাছাই না করে সেই অতীতের জীবনে চলে যান। সাফা-মারওয়াতে ‘ছায়ী’ হাজীর মনে দৃঢ় আশা ও মহান আল্লাহর রহমতের অবারিত প্রত্যাশা বৃদ্ধি করে। হজ পরবর্তী দুনিয়াবিমুখ হাজীদের আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক কঠিন পরীক্ষারও সম্মুখীন হতে হয়। মুসলিম জাতির আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর জন্য কঠিনতম পরীক্ষা শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল আ: ও বিবি হাজেরা আ:কে শুষ্ক মরুপ্রান্তরে ক্ষুধার জ্বালা প্রাণ বিনাশের আশঙ্কাসহ অনেক পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

আল্লাহর রাস্তায় কার্যরত থাকা অবস্থায় বান্দার পরীক্ষা করা হবে, ভয়ভীতি, ক্ষুধা, অনাহার, জান-মাল ও ফসলাদির ক্ষতি সাধন করে। (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৫৫) আর সত্যিকারের মুমিনরা বিপদে পতিত হলেও তাঁরা কোনো ভয়-ভীতি না করে বলবে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্যই, আর নিশ্চিত আমরা আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৫৬) ‘আর এ পরীক্ষায় যারা টিকে থাকবে সেই দৃঢ়বিশ্বাসীরা মহান আল্লাহর সমগ্র দয়া, রহমত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৫৭)

সাফা-মারওয়াতে ‘ছায়ী’ প্রত্যেক হজ ও উমরাহ পালনকারীকে পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরায়ে বাকারাহর ১৫১-১৫৭ আয়াতে বর্ণিত সব অপশক্তির বিরুদ্ধে অগ্নিপরীক্ষায় টিকে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিশ্চয় সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত। (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৫৮) অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘আর যারা আল্লাহকে স্মরণ করবে, আল্লাহ পাকও তাদের স্মরণ করবেন।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৫১) মহান রাব্বুল আলামিনকে জিকিরের সাথে স্মরণ এবং তাঁর সাথে সব ইসলামবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সূরা বাকারাহর ১৫১-১৬৩ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ছায়ীর তাৎপর্য মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য কতটুকু অপরিহার্য সেটি উপলব্ধি করা। সব হাজীর জীবন হোক রহমতের চাদরে পরিবেষ্টিত, চোখের গোনাহমুক্ত, হাতের গোনাহ, পায়ের গোনাহ, কথার গোনাহ সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পাপাচারমুক্ত। জঙ্গলে অনেক কাঁটা কিন্তু চলাফেরা করতে যেন পায়ে কাঁটা না বেঁধে, এই হলো তাকওয়ার মূল তত্ত্ব। তাহলেই সৌভাগ্যময় হয়ে যাবে একজন হাজীর মৃত্যুপূর্ব জীবনযাত্রা। তাহলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা পঞ্চ স্তম্ভবিশিষ্ট গৃহের মতো পূর্ণতা পাবে, আর চতুর্থ স্তম্ভ হজও তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাত্রার সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, ইনশাআল্লাহ!

লেখক : অতিথি অনুবাদক মসজিদুল হারাম, কাবা শরিফ এবং সাবেক ইমাম ও খতিব : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ মসজিদ