বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব দাবি করে অমিতাভ দেউরীর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আবেদন খারিজ করে দিয়েছে কপিরাইট অফিস। উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্ক এবং নথিপত্র যাচাই বাছাই করে অমিতাভ দেউরীকে নয় নাজমুল হোসেনকেই পান্ডুলিপির রচয়িতা হিসেবে প্রতিবেদন দিয়েছে।
পিক্টোরিয়াল গ্রন্থটি কোন মৌলিক নয় উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থটি একক সৃষ্টি নয়, অমিতাভ দেউরী বইটির প্রণেতা নন। তিনি সাত লক্ষ টাকার বিনিময়ে সম্পাদক হিসেবে দাপ্তরিক কাজ করেছেন। কপিরাইট অফিসে গত ২৬ আগস্ট ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থের কপিরাইট বাতিল চেয়ে আবেদন করেন অমিতাভ দেউরী। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১০ সেপ্টেম্বর আইনজীবীসহ অমিতাভ দেউরী এবং নাজমুল হোসেন শুনানিতে নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
পরবর্তীতে উভয় পক্ষই লিখিত বক্তব্য ও প্রয়োজনীয় প্রমাণাদিসহ দাখিল করেন। ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ রায়হানুল হারুন নথিপত্র যাচাই করে রেজিস্টারের কাছে প্রতিবেদন দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থের ছয় মাস পূর্বেই জার্নির গবেষণায় পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এতে নাজমুল হোসেন ছবি সংগ্রহ এবং গবেষণার কাজ করেছেন। ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি ৩২০ পৃষ্ঠার এবং ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২৪। দুইটি বইয়ের ১৭২টি পৃষ্ঠার ২০২টি ছবির হুবুহু মিল রয়েছে। দুইটি গ্রন্থের ক্যাপশন এবং পৃষ্ঠাবিন্যাস প্রায় মিল রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ছয় মাস পূর্বে প্রকাশিত ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ গ্রন্থের সাথে অমিতাভ দেউরী যুক্ত ছিলেন না। ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ পান্ডুলিপি তৈরীর পর নাজমুল হোসেন গ্রন্থটির প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা, প্রুফ রিডিংয়ের জন্য সাত লক্ষ টাকা দিয়েছেন। কপিরাইট অফিসের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, মানিরিসিটে অমিতাভ দেউরীর স্বাক্ষরের সাথে কপিরাইট অফিসে আবেদনে প্রদত্ত স্বাক্ষরে সুস্পষ্ট মিল আছে। এছাড়াও অমিতাভ দেউরী কপিরাইট অফিসে দেয়া লিখিত বক্তব্যে নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে আংশিক টাকা প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে তাঁর কোন ধরণের যোগাযোগ হয়নি এবং ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থের ছবি নাজমুল হোসেনের মাধ্যমেই পেয়েছেন লিখিত বক্তব্যে এমনটাই উল্লেখ করেছেন অমিতাভ দেউরী।
ডেপুটি রেজিস্টারের দেয়া প্রতিবেনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ৩২৪ পৃষ্ঠার পিক্টোরিয়াল গ্রন্থে অমিতাভ দেউরী মাত্র এক পৃষ্ঠা লিখেছেন। গ্রন্থে ব্যবহৃত তিনটি প্রবন্ধ এবং সম্পাদনা পর্ষদের কাজের স্বত্ত্ব লিখিতভাবে জার্নি মাল্টিমিডিয়ার। বইটির পরিকল্পনা, অর্থায়ন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের পুরো কাজটি করেছেন নাজমুল হোসেন।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থটির বাণিজ্যিক কপিরাইট স্বত্ত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের। মৌলিক সাহিত্যকর্ম দাবি করলেও অমিতাভ দেউরী কোনভাবেই গ্রন্থটির রচযিতা নন বলে মন্তব্য করেছেন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, নতুন প্রকাশনায় অমিতাভ দেউরীর নাম সম্পাদক হিসেবেই রাখা হয়েছে। এতে তাঁর কোন নৈতিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়নি। কিন্তু তিনি বাণিজ্যিক কপিরাইট স্বত্ব দাবি করে অভিযোগ করলে তা খারিজ করে দেয়া হয়েছে।
দুই পক্ষকেই ইতোমধ্যে প্রতিবেদনের সার্টিফাইট কপি দেয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থের বাণিজ্যিক স্বত্ত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের। পান্ডুলিপি রচয়িতা হিসেবে নাজমুল হোসেন গ্রন্থটির প্রধান গবেষক। কারণ এই গ্রন্থের ছয়মাস পূর্বেই তিনি অনুরুপ আরেকটি পিক্টোরিয়াল গ্রন্থের কাজ করেছেন ‘ কপিরাইট অফিসে অভিযোগ খারিজ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অমিতাভ দেউরী জানিয়েছেন, তিনি এই রায়ে সংক্ষুব্ধ। কপিরাইটের অধিকার ফিরে পেতে তিনি কপিরাইট বোর্ডের কাছে আপিল করবেন। প্রয়োজনে আদালতের দারস্থ হবেন।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ গ্রন্থের প্রধান গবেষক এবং জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী নাজমুল হোসেন জানান, শিশুরা বঙ্গবন্ধুকে জানবে এই মহতী উদ্যোগকে বাধাগ্রস্থ করতেই একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। মুজিববর্ষে ৬৫ হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু বুক কর্ণার বাতিল করতে স্বাধীনতা বিরোধীদের অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। একজন ভদ্রলোক নিজেকে লেখক দাবি করে গণমাধ্যমের সামনে মিথ্যাচার করেছেন। যা সত্যিই দু:খজনক। কপিরাইটের বিষয়টি নিস্পত্তি হওয়ার পরও তিনি নানা অজুহাত দেখিয়ে কোমলমতি শিশুদের কাছে বঙ্গবন্ধুর বই পৌছাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছেন। আমার বিশ্বাস জনাব অমিতাভ দেউরী একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিবেন।
এদিকে হাইকোর্টে একটি রিট নিস্পত্তি না হওয়ায় গত ৫ মাস ধরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ৮টি বইয়ের ৫ লক্ষ ২৫ হাজার কপি বই বিদ্যালয়ে পাঠানো যাচ্ছে না। অথচ বই পাঠানো এবং তালিকায় থাকা অন্য বই ক্রয়ে হাইকোর্টের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এবিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম। উল্লেখ্য ইতোমধ্যে সংসদীয় তদন্ত কমিটি বঙ্গবন্ধু বুক কর্ণারে বই ক্রয়ে কোন অনিয়ম পায়নি। নাজমুল হোসেন কোন দুর্নীতির সাথে জড়িত নয় উল্লেখ করে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ এবং ‘৩০৫৩ দিন’ দুইটি বইয়ের গ্রন্থস্বত্ত্ব নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদকে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি। একইসাথে আগামী বছর ১৭ মার্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বুক কর্ণারের বাকি ৫৮টি বইয়ের ৩৮ লক্ষাধিক বই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।