মোঃ আশরাফুল আলম : একটি গাছ গড়ে পঞ্চাশ বছরে যে উপাদান ও সেবা দিয়ে থাকে তার আর্থিকমূল্য বিবেচনা করলে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় চল্লিশ লাখ টাকার অংকে। একটি গাছ এক বছরে দশটি এসি’র সমপরিমাণ শীতলতা দেয়, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে, ৬০ পাউন্ড ক্ষতিকর গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। এক হেক্টর সবুজ ভূমির উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ চলাকালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় নয়শ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ৬৫০ কেজি বিশুদ্ধ অক্সিজেন প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়। এছাড়াও বৃক্ষরাজি আবহাওয়ার তাপমাত্রা হ্রাস করে, বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায় ও ভূমিক্ষয় রোধ করে। তাই পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা৷ ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০। ঢাকামুখী মানুষের স্রোত প্রতিদিন বাড়ছে৷ নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ৷ ফলে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে শহরটি৷ থাকার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে৷ বাড়ির ছাদের চিলেকোঠাও বসবাসের জায়গা হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে। বসতি বাড়ার সাথে সাথে এখানকার পরিবেশ দিন দিন প্রতিকূলে যাচ্ছে মানুষের৷
অন্য বছরগুলোর তুলনায় এই বছর প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসীর জীবন৷ বৃদ্ধি পেয়েছে তাপমাত্রা৷ শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে ফাঁকা ছাদ, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক৷ এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করতে হলে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই৷ যেহেতু সমতলে গাছ লাগানোর জায়গা তেমন নেই, সেহেতু বাড়ির ছাদে কিংবা ব্যালকনিতে সঠিকভাবে বাগান করা হলে তাপমাত্রা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
ঢাকা শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, যা এই নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অনেকাংশে দায়ী৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ঢাকা শহরের সব ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করা যায় তবে তাপমাত্রা প্রায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো যেতে পারে।
ঢাকা শহরের কংক্রিটের কাঠামো মূলত শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে৷ অধিক জনসংখ্যা, অতিরিক্ত নগরায়ন, যানবাহন, জলাধার ও গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে ঢাকার পরিবেশ দূষণ বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় অনেক বেশি৷ ঢাকা শহরের গাছপালার পরিমাণ ১৯৮৯ সালে ছিল ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে কমে ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে৷ অন্যদিকে ঢাকা শহরের বাৎসরিক গড় তাপমাত্রা ১৯৮৯ সালে ছিল ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিন্তু এটি ২০০৯ সালে বেড়ে দাড়িয়েছে ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ আর এই বছর কত হয়েছে সেটা আমরা প্রায় সবাই জানি।
ঢাকায় মাটি ও খোলা যায়গার অস্তিত্ব দিনকে দিন কমে যাচ্ছে৷ হারিয়ে যাচ্ছে খোলা জায়গা৷ বাড়ছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। ইট-কাঠের বদলে দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো ও কাচে মোড়ানো বহুতল ভবন৷ বাণিজ্যিক ভবনগুলোর টেকসই স্থাপনা ও দৃষ্টিনন্দনের বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবহার করা হচ্ছে হালকা, কিন্তু শক্তিশালী ধাতব পাত, ফাইবার ও গ্লাস৷ এতে করে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে কেননা, সূর্য থেকে তাপ ও আলো ধাতব ও কাচের কাঠামোর একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হয়৷ বারংবার প্রতিফলনের কারণে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় সামান্য বেড়ে যায় এবং শহরজুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য হিট আইল্যান্ড বা তাপ দ্বীপ৷
এদিকে ঢাকার বাহিরে যে পরিমান বনায়ন কর্মসূচি নেয়া হলেও ঢাকাতে সেটা অপ্রতুল। যে পরিমাণে গাছ কাঁটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। গাছ শুধুমাত্র কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে মানুষকে বাচায় না বরং বৃষ্টিপাত ঘটাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, গাছের পাতা, ডাল, বাকল, নানান ধরনের ঔষধ হিসাবেও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে গরমকালে একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং অন্যদিকে শীতকালে ঠান্ডার পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে সাথে পরিবেশ পড়ছে হুমকির মুখে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ছাদবাগান আছে এইরকম দালানের কক্ষের ভেতরের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ১.০ থেকে ১.২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত কমায়। এমনকি ঘরের বারান্দায় যাদের বাগান আছে তাদের ঘরের ভীতর থেকে বারান্দার তাপমাত্রা কম থাকে। এছাড়াও ছাদবাগান করার কারনে আশেপাশের এলাকায় কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান প্রায় ৭০ পিপিএম পর্যন্ত কমে যায়। যদি ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ছাদবাগানের প্রসার করা যায়, তবে এটি একদিকেন যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য বায়ু দূষণকারী উপাদানের মাত্রা কমিয়ে পরিবেশ দূষণ কমাবে এবং অন্যদিকে এই ভয়ানক তাপদাহও কমাবে। এছাড়া নগর কৃষির মাধ্যমে শহরের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে জাতীয় উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ তে বিশেষায়িত কৃষির আওতায় ছাদকৃষির প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ছাদবাগান স্থাপনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও আর্থিক ও কারিগরি সহায়তাও বেশ জরুরি। সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ছাদবাগান সম্প্রসারণের কৌশল নির্ধারণ করাও প্রয়োজন। ছাদ বাগান ও নগর কৃষির জন্য সরাকারে পাশাপাশি বেসরকারী কৃষিজ প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নানান ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া এখন সময়ের দাবি।
উল্লেখ্য, অনেকেই এখন গরমে গাছ লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন কিন্তু বাড়ির বাহিরে গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় আষাঢ় মাস। এখন প্রখর রোদে গাছ লাগালেও সেই গাছ মারা যাবার সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হলেও গাছ বেড়ে উঠার জন্য সেটা পরিমিত হবে না। সেই হিসেবে এখন ঘরের মধ্যে ইনডোরে গাছ লাগানো এবং আসন্ন পবিত্র ইদ-উল-আযহা’র সময় বাড়ির বাহিরে গাছ লাগানোই উত্তম হবে।
লেখক : পরিবেশকর্মী ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, ‘গো উইথ আশরাফুল আলম’