আবু দারদা যোবায়ের : কথাটা কি সত্য ? হ্যাঁ কখনো সত্য বটে । তা না হলে একমাস সিয়াম সাধনার দিনগুলোতে ইফতারিতে যার ( বেগুনের ) এতো কদর তাকে এতো সহজেই রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিলাম ! কেউ এখন মাগনাও নিতে চাচ্ছে না বলে বেপারি বিক্রেতা এভাবে ফেলে চলে গেছেন।
অনাথ এতিমের মতো রাস্তায় শুয়ে আছে বেগুন ! কিছু দিন আগেও ইফতারের যেই বেগুন ছিল অন্যতম অনুসঙ্গ! শনিবার ( ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ) সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আম্বরশাহ মসজিদের উত্তর পূর্ব কোনায় রাস্তায় পড়ে ছিল বেগুনের সারি/ কাড়ি। ছবি তোলার সময় হাতে নিয়ে দেখেছি ভালো না পোকড়া ? আমার কান্ড দেখে আশপাশের ভ্যানের দোকানদার বললেন লইয়া যান ! জবাবে বললাম বিক্রি করতে পারেন নাই বলে বিক্রেতা এভাবে ফেলে রেখে গেছেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিস এর তথ্য মতে , দেশে হালকা বেলে থেকে ভারী এটেল মাটি অর্থাৎ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই বেগুনের চাষ করা হয়। হালকা বেলে মাটি আগাম জাতের বেগুন চাষের জন্য উপযোগী। এই ধরণের মাটিতে বেগুন চাষ করতে হলে প্রচুর পরিমাণ জৈবসারসহ অন্যান্য সার ঘন ঘন প্রয়োগ করতে হবে। এটেঁল দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি বেগুন চাষের জন্য উপযোগী এবং এই মাটিতে বেগুনের ফলন বেশী হয়। বেগুন চাষের জন্য নির্বাচিত মাটি গভীর, উর্বর ও সুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে বেগুনের বহু জাত রয়েছে। এক জাত থেকে অন্যজাতে গাছের প্রকৃতি, ফলের রং, আকার, আকৃতি প্রভৃতি আলাদা। বাংলাদেশে প্রধানতঃ লম্বা ফল, গোলাকর ফল ও গোলাকার এই তিন ধরণের বেগুনের চাষ বেশী হয়ে থাকে। সব জাতকে মৌসুম ভিত্তিক দুই ভাবে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন-শীতকালীন বেগুন ও বারমাসী বেগুন। শীতকালীন জাতের বেগুন রবি মৌসুমে চাষ করা হয় কারণ, এই জাতের বেগুন কেবলমাত্র রবি মৌসুমেই ফল দিতে পারে। আর বারমাসী বেগুন বছরের যে কোন সময় চাষ করা যেতে পারে।
ফলের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিপক্ক পর্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছানো পর্যন- বেগুন খাওয়ার উপযুক্ত থাকে। সাধারণতঃ ফুল ফোটার পর ফল পেতে গড়ে প্রায় ১ মাস সময় লাগে। জাত ভেদে হেক্টর প্রতি ১৭-৬৪ টন ফলন পাওয়া যায়।
বছরজুড়ে চাহিদা থাকে সবজিটির। তবে এ চাহিদা সবচেয়ে বেশি হয় রমজান মাসে। কিন্তু এবার রমজানের শুরুর দিকে কয়েকদিন কিছুটা চড়ামূল্যে বেগুন কিনে খেতে হয়েছে ভোক্তাদের।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতি মৌসুমেই বিভিন্ন সবজির উৎপাদন খরচের হিসাব রাখে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী এক কেজি বেগুন উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকা ২৬ পয়সা। যদিও কৃষকরা বলছেন, রোগবালাই থেকে বাঁচতে বেগুনে অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে।
এই রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হয়েছে ২ টাকা থেকে ১০ টাকা। বিভিন্ন হাত ঘুরে রাজধানীতে বেগুন দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে কিনতে হয়েছে ভোক্তাদের।
দেশে গত কয়েক বছরে বেগুনের উৎপাদন বেড়েছে।
দুই মৌসুমেই বেগুন উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে রবি মৌসুমে ৪ লাখ ৯ হাজার টন বেগুন উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৭২ হাজার টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের খরিপ মৌসুমে ২ লাখ ৯ হাজার টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ লাখ ২৩ হাজার টন বেগুন উৎপাদন হয়।
গত রোজার শুরুতে দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষক পর্যায়ে বেগুনের কেজি ছিল ১০ থেকে ২০ টাকা। সেই বেগুন রাজধানী ঢাকায় ৮০ থেকে এক”শ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হয়েছে । কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই দাম পড়ে যায়। রাজধানীর বাজারে ভালো মানের বেগুন ৪০ টাকায় । দশ রোজার মধ্যে খুচরা বাজার থেকে আমার মতো অনেকেই বেগুন ২০ থেকে ৩০ টাকায় কিনেছেন।
রাজধানীর বাইরে নরসিংদীর জেলার শিবপুর,ও মাধবদী থানার বিভিন্ন বাজারে রমজানের মাঝামাঝি ভালো মানের বেগুন খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা কেজিতে । এছাড়া , কৃষক পর্যায়ে কুমিল্লার নিমসার , নেত্রকোনার পূর্বধলা, রংপুরের কুড়িগ্রামে ২ টাকা কেজি দরে বেগুন বিক্রি করেছেন চাষীরা । উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে বেগুন বিক্রি করে কৃষকের মাথায় এখন হাত !
তাই কৃষকের মুখে এবার শোনা গেল ‘ আর চাষ করমু না বেগুন ! প্রান্তিক কৃষক যদি এবারের অভিজ্ঞতায় আগামী বছর বেগুন চাষ না করেন , তাহলে আমার মতো রোজাদার যাদের বেগুনী খেতে হয় ইফতারিতে তাদের কি দশা হবে? প্রশ্ন হলো কৃষকের অর্থনীতিটা আমরা অনেকেই বুঝতেছিনা । যদি বুঝতাম কিংবা বুঝার চেষ্টা করতাম তাহলে কৃষকের পাশে দাঁড়াতাম।
বেগুন কিংবা অন্যকোনো সবজির ন্যায্য মূল্য কৃষককে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই সাথে বেগুনের ভোক্তাদের কাছে সহনীয় করতে হবে মূল্যস্ফিতির বোঝা । অর্থাৎ কেজিপ্রতি বেগুন উৎপাদনে কৃষকের মোট খরচ তথা উৎপাদন খরচ হিসাব কষে পাইকারি বাজারে বেগুনের কেজিপ্রতি বিক্রয় মূল্য এবং খুচরা বাজারে সাধারণ ভোক্তা বেগুনের কেজি প্রতি দাম ঠিক করে দিতে পারলেই বেগুনের বাজার উৎপাদক , পাইকারি বাজার, আড়তদার, খুচরা বাজারে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব ।
সরকারের কৃষি মন্ত্রনালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে শস্য , বীজ উৎপাদনের মতো কৃষি জাত পন্য উৎপাদনের সাথে জড়িতদের উচিত বেগুন সহ নানা সবজি উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সমন্বিত বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করা উচিত। দেশে চাহিদার চেয়ে বেশী বেগুন সহ অন্যান্য সবজি উৎপাদন বেশী হলে সরকারিও বেসরকারি ভাবে বিদেশে রপ্তানী করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের কৃষি , খাদ্য ও বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহন জরুরী বলে মনে করি।
লিখেছেন : আবু দারদা যোবায়ের, সিনিয়র সাংবাদিক