স্বাস্থ্য খাতের অসুস্থতা দূর করা কি সম্ভব ?

আবু দারদা যোবায়ের : আইন-কানুন ও নিয়মনীতি এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ব্যবসা করার অভিযোগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টি সেন্টার বন্ধ কিংবা সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে। এমন খবর গত এক সপ্তাহ ধরে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।

এগুলো করা হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। কোথাও আবার র‌্যাবের অভিযানও চলছে। এই অভিযান শুরুর পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া কিংবা জরিমানা করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে সতর্ক করা হয়েছে।

নিঃসন্দেহে এগুলো ভালো উদ্যোগ। তবে এই উদ্যোগ যাতে মাঝপথে থেমে না যায় সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বিত চেষ্টা ও অভিযান অব্যাহত রাখতে পারলে দেশের রুগ্ণ ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিসম্প্রতি কিছু নির্দেশনা দিয়ে তা দ্রুত বাস্তাবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক মঈনুল আহসান।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের কেয়ার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক এবং উত্তরা হাইকেয়ার কার্ডিয়াক অ্যান্ড নিউরো হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্যামলীর ঢাকা ট্রমা সেন্টার ও স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক ল্যাব বন্ধ করা হয়েছে।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশের লাইসেন্সবিহীন, অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংক বিধি মোতাবেক জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করতে এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

নির্দেশনা মোতাবেক পরিদর্শন কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন পরিদর্শনে শ্যামলীর হাইকেয়ার অর্থোপেডিকস ও জেনারেল হাসপাতালকে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। একই এলাকার ইসলাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কালার কোডেড বিন (মেডিকেল বর্জ্য রাখার রঙিন পাত্র) সঠিক না থাকায় প্রতিষ্ঠানটিকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেন পরিদর্শনকারী দলের সদস্যরা। এ ছাড়া শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালকে তথ্য কর্মকর্তার নাম ও ছবি টাঙাতে এবং এসবিএফ কিডনি কেয়ার সেন্টারকে একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিন রাজধানীর লুবানা হাসপাতাল, উত্তরা ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক এবং উত্তরার ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করেন কর্মকর্তারা।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর ১০টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিদর্শন কর্মসূচির প্রথম দিন সারা দেশে ১৬টি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিলগালা করা হয় দুটি প্রতিষ্ঠানকে। এদিন মোট ৩৭টি স্বাস্থ্যসেবা খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কিছু প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করা হয়।

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের বেহাল চিত্র নতুন নয়। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ কত কষ্ট ও বিড়ম্বনার শিকার হয়, একমাত্র ভুক্তভোগী রোগী ও তার স্বজনরাই জানেন। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের চিকিৎসা ব্যয় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বহুগুণ বেশি। অনেকের পক্ষে সেই বাড়তি টাকা দিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়াও আরো কঠিন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোতে ডাক্তার সংকটের পাশাপাশি রয়েছে নানা আধুনিক চিকিৎসাযন্ত্রের অভাব। প্রয়োজনীয় জনবল সংকট তো রয়েছেই। পাশাপাশি নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে কঠিন করে তুলছে। স্বাস্থ্যসেবা খাততে দিনদিন রুগ্ণ দশায় ঠেলে দিচ্ছে।

প্রায়ই দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে রুগ্ণ ও অসুস্থ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে প্রতিবেদন লক্ষ করা যায়। বিগত করোনাকালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি টেকনিশিয়ান, নার্সসহ স্বাস্থ্য সহকারীর অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা কীভাবে ব্যাহত হয়েছিল তা ভুক্তভোগী অনেকেরই মনে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে করোনাকালে জরুরি ভিত্তিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট ছিল না। করোনা-পরবর্তীকালে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অতীতে আবার দেখা গেছে, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ সঠিকভাবে খরচ করতে না পারায় সেই বাজেটের বিরাট অংশ ফেরত পাঠানো হয়েছে।

জনবল সংকট দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নড়বড়ে করেছে। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের সংকট, এক্স-ওে, এমআরআই মেশিন সংকট ছিল নিত্য সংকটের চিত্র। আবার কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ও মেশিন থাকলেও টেকনিশিয়ানের অভাবে মাসের পর মাস লাখ লাখ টাকা দামের মেশিন ছিল নষ্ট। কিংবা মেশিন চালু করার কিছুদিন পরই সেই মেশিন অচল। দিনের পর দিন এক্স-রে মেশিন পড়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায় এমন খবরও প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় লেখা হচ্ছে।

ফলে রোগীরা বাধ্য হয়েই এক্স-রের জন্য ছুটছেন সরকারি হাসপাতালের কয়েক শ গজের মধ্যে থাকা বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। যেখানে সরকারি হাসপাতালে কম টাকায় নানা রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়, সেখানে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি অকেজো থাকায় রোগীদের বিশেষ করে গরিব রোগীদের বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে রোগ নির্ণয় করতে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, দেশে এক হাজার ২০০ অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নেই। অথচ তারা কীভাবে চলছে এবং রোগীরা কীভাবে সেবা পাচ্ছেন তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তবে আশার কথা, নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে একজন দক্ষ ও পেশাদার চিকিৎসক। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা বলেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তিনি এমন দৃঢ়সংকল্পের কথা বলছেন।

ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক বিশেষ বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেছেন, এখন থেকে বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম চালাতে হলে সরকারি নিয়ম মেনে চলতে হবে।

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি যে, কিছু অসাধু ব্যক্তি সরকারি বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে ব্যাবসায়িক স্বার্থে সর্বত্র হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করছে।’
সামন্ত লাল বলেন, ১ হাজার ২০০ অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নেই। অথচ তারা কীভাবে চলছে এবং রোগীরা কীভাবে সেবা পাচ্ছেন তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০ দফা গাইডলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, নির্দেশনা উপেক্ষা করলে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে নির্দেশিকাগুলো হলো-

ক. প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্সের কপি প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকের সামনে দৃশ্যমান স্থানে স্থায়ীভাবে প্রদর্শন করতে হবে।
খ. সব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সব তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা বা কর্মচারী থাকতে হবে এবং তার ছবি ও মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে।
গ. যেসব প্রতিষ্ঠান ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল নামে আছে, কিন্তু তাদের কেবল ডায়াগনস্টিক বা হাসপাতালের লাইসেন্স আছে তারা লাইসেন্স ছাড়া নামে উল্লিখিত সেবা কোনোভাবেই প্রদান করতে পারবে না।
ঘ. ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির ক্ষেত্রে যে ক্যাটাগরিতে লাইসেন্স গ্রহণ করা হয়েছে, সে ক্যাটাগরিতে নির্ধারিত পরীক্ষা ব্যতীত অন্য কোনো পরীক্ষা করা যাবে না এবং ক্যাটাগরি অনুযায়ী প্যাথলজি বা মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে।
ঙ. বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের ধরন ও শয্যাসংখ্যা অনুযায়ী সব শর্ত বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
চ. হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়োজিত সব চিকিৎসককে অবশ্যই পেশাদার ডিগ্রির সনদের কপি, বিএমডিসির হালনাগাদ নিবন্ধন ও নিয়োগপত্রের কপি সংরক্ষণ করতে হবে।
ছ. হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অপারেশন বা অস্ত্রোপচার বা পদ্ধতির জন্য নিবন্ধিত চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে।
জ. লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ব্যতীত কোনো অবস্থাতেই চেম্বার বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এনেসথেসিয়া প্রদান করা যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ এনেসথেটিস্ট ছাড়া কোনো অপারেশন বা সার্জারি বা ইন্টারভেনশনাল অপারেশন করা যাবে না।
ঝ. সব বেসরকারি নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল বা ক্লিনিককে অবশ্যই লেবার রুম প্রটোকল মেনে চলতে হবে।
ঞ. নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটার অবশ্যই অপারেশন থিয়েটার শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে।

দেশে অনিবন্ধিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির সংখ্যা কয়েক হাজার। এর মধ্যে নিবন্ধিত এসব চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম হলেও এগুলোতে নেই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল এবং যন্ত্রপাতি। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় আইসিইউ, সিসিইউ, এমআর আই, সিটি স্ক্যান সেবা। এগুলো বাস্তবে নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি অক্সিজেন সাপোর্ট ও নবজাতক শিশুর প্রাথমিক পরিচর্যাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো করতে গেলে অবশ্যই সরকারি হাসপাতালের বাড়তি আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। শুধু আধুনিক যন্ত্রপাতি বসালেই হবে না ওই সব আধুনিক যন্ত্র পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন হবে দক্ষ টেকনিশিয়ান।

অতীতে স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় নানা অনিয়ম হয়েছে। হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও লুটপাট। যে অনিয়মগুলো অতীতে হয়েছে, সেগুলো আগামীতে যাতে না হয় সেদিকে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
আরেকটি বিষয় শুধুমাত্র সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল দিয়ে দেশের বিপুল বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি পর্যায়ে ব্যক্তি খাতে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, ক্লিনিক স্থাপনের অনুমতি দিতে হবে।

বেসরকারি খাতের যারা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগ পরীক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন অর্থাৎ বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাচ্ছেন তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে যারা এগিয়ে আসবেন, তাদের বিনা শুল্কে কিংবা ন্যূনতম শুল্কে চিকিৎসাসেবার আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এটা করতে পারলে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। বিনিয়োগ হলেই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, মানুষ দেশেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাবে। চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখিতা কমবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ- দেশের ডলার দেশেই থাকবে। সরকারি হাসপাতালে স্বল্প টাকায় রোগীদের চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে তুলনামূলক কম টাকায় মানুষ চিকিৎসা নিতে পারলে স্বাস্থ্যসেবা খাত উন্নতির দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে।

তবে বর্তমানে চলমান অভিযানে একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পৌরসভা এলাকায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিক স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা পাতিনেতারা।

অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ভরপুর রোগীদের রক্ত চুষে টাকা নেওয়ার কারিগর তথাকথিত হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম কিংবা স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। ওই সব হাসাপাতালের অনিয়মের বিরুদ্ধে। সুতরাং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাক্তার সামন্ত লাল সেনের ‘জিরো টলারেন্স’ কতটুকু সফল হবে, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান কতটুকু আলোর মুখ দেখবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

যেকোনো ভালো উদ্যোগ শুরুতেই কিছুটা হোঁচট খেতে পারে। কেননা যারা মাঠ পর্যায়ে আইনের বাস্তবায়ন করবেন, তাদের মধ্যে সৎলোকের পাশাপাশি অসৎলোকের দৌরাত্ম্যও কোনো অংশে কম থাকে না। সেই অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সৎ উদ্যোগকে বানচাল করতে না পারে, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর ও দৃঢ় পদক্ষেপ দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাততে ভগ্ন দশা থেকে উদ্ধারে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত শক্তিশালী হলে আমাদের দেশের রোগীরা সামান্য চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাবেন না। আর তা না করা গেলে চিকিৎসাসেবায় রোগীদের আস্থা না বাড়াতে না পারলে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাওয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন অব্যাহত থাকবেই। বিদেশমুখিতা ঠেকাতে পারলে একদিকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। সবার আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এক জন রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এখন আমাদের দেশেই সম্ভব। পেশাদার চিকিৎসক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল দেশের চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তা যেন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী এমপি, আমলা, প্রভাবশালী মহল এবং চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের অপতৎরতায় ব্যর্থ হয়ে না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

অন্যথায়, রুগ্ণ ও ভঙ্গুর এবং অসুস্থ স্বাস্থ্যসেবা খাত দিয়ে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাওয়া রোগীর স্রোত যেমন থামানো যাবে না, তেমনি দেশের গরিব-দুঃখী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে না। পরিশেষে বলতে চাই, দেশের স্বাস্থ্যসেবা তথা চিকিৎসাব্যবস্থাকে জনগণের আস্থায় আনতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাক্তার সামন্ত লাল সেনের আন্তরিক চেষ্টা চূড়ান্তভাবে যাতে সফল হয় সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নিবিড়ভাবে অব্যাহত রাখা জরুরি ।

লিখেছেন : আবু দারদা যোবায়ের, সিনিয়র সাংবাদিক