রেল প্রকল্পের টাকায় স্বেচ্ছাচারী ইরফানুল

বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্লিনার পদে চাকরি পেয়েছিলেন জামালপুরের সাকিবুল ইসলাম। তার কর্মক্ষেত্র জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ও ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে; কিন্তু যোগদানের পর থেকেই প্রকল্পের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা রেলের সংগ্রহ শাখার উপপরিচালক ইরফানুল ইসলামের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করছেন সাকিব।

শুধু রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কর্মচারীকে বাসার কাজে নিয়োজিত করেই ক্ষান্ত হননি ওই কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করছেন প্রকল্পের টাকায় কেনা দুটি গাড়ি। চালকসহ এসব গাড়ির খরচ বাবদ প্রতি মাসে সরকারকে লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকেও অনৈতিক সুবিধা নেন তিনি। দুই সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধানে ইরফানুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ও ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (সদর) ইরফানুল ইসলামকে ২০২২ সালে রেলের সংগ্রহ শাখার উপপরিচালক পদে বদলি করা হয়। তবে তদবিরের মাধ্যমে প্রকল্পের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়ে যান তিনি। সেই থেকে নানাভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে ইরফানুলের পরিচয় ‘স্বেচ্ছাচারী সম্রাট’ হিসেবে। তারা বলছেন, রেলে সব কিছুই হয় তার ইচ্ছামতো। সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারীরা যেন তার কেনা গোলাম আর সরকারি টাকায় কেনা গাড়ি তার নিজের সম্পত্তি! ইরফানুলের এমন বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের পেছনে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার আশীর্বাদ রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্পে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই ইরফানুল ইসলামের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে হচ্ছে সাকিবুল ইসলামকে। প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত সেখানেই দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। এই সময়ে ওই কর্মকর্তার সন্তানদের সেবাযত্ন, রান্না ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ বাসার সব কাজ করতে হয়। যদিও মাস শেষে প্রকল্প থেকেই ১৭ হাজার ৬০০ টাকা বেতন দেওয়া হয় তাকে। মাসে দু-এক দিন প্রকল্প অফিসে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে আসেন।

এ বিষয়ে সাকিবুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রকল্পের কর্মকর্তা ইরফানুল ইসলামের বাসায় দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।

শুধু সাকিব নন, ছুটির দিনে এ প্রকল্পের অন্য কর্মচারীদেরও ওই কর্মকর্তার বাসার কাজ করতে হয়। কথা না শুনলে চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি। এ কারণে একজন কর্মচারী প্রকল্পের চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাকিবের আগে ইরফানুলের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন ওই প্রকল্পের অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ পাওয়া সৌখিন নামে এক কর্মচারী। পরিবারটির দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে প্রকল্পের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন তিনি। যোগাযোগ করা হলে সৌখিন দৈনিক কালবেলাকে জানান, ‘২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্পে নিয়োগ পেয়েছিলাম। অফিস সহায়ক পদে চাকরি হলেও ইরফান স্যারের ছেলের দেখাশোনা এবং বাসার বিভিন্ন কাজ করতে হতো। মাঝে মাঝে অফিসে গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসতাম। কিন্তু স্যারেরা অনেক দুর্ব্যবহার করতেন, এ কারণে ৭-৮ মাস পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের টাকায় কেনা তিনটি গাড়ির মধ্যে দুটিই এখন ইরফানুলের দখলে। গাড়ির দুটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঠ-১৩-৬৯৭৮ এবং ১৩-৬৯৭৯। বেশিরভাগ সময় গাড়িগুলো ব্যবহার হয় তার পারিবারিক কাজে। কর্মকর্তার বাসার বাজার করা, ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া-আসার জন্য ব্যবহার করা হয় গাড়িগুলো। গাড়ি দুটির চালকরাও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই কর্মকর্তার পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকেন। এমনকি ছুটির দিনেও একইভাবে কাজ করতে হয় তাদের।

প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে আপাতত কোনো কাজ না থাকলেও দুটি গাড়ির জ্বালানি খরচ ও চালকদের বেতন সরকারকেই দিতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে পাওয়া নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পারিবারিক কাজে ব্যবহার করলেও শুধু গাড়ি ব্যবহারেই প্রতি মাসে সরকারের অপচয় হচ্ছে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া দুই চালকের বেতন হিসেবে আরও ৩৫ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে।

জানা গেছে, শুধু জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্পের দুই গাড়ি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি ইরফানুল। রেলওয়ে কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটিজ (আরসিআইপিএফ) প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও একটি নিশান গাড়ি উপহার নিয়েছেন তিনি— যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-২০৮৬। গাড়িটির ব্যয় বহন করেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই। এ প্রকল্পেও অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন রেলের এই কর্মকর্তা।