মধ্যবিত্তের চাপা কান্না!

একটা পরিসংখ্যান করে দেখবো কি না ভাবছিলাম। পরে আবার মনে হলো পরিসংখ্যানের কিছু নেই। চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় এ দেশে মধ্যবিত্ত, নিন্মমধ্যবিত্ত জনগনের সংখ্যা বেশী। ছোট বেলা থেকে অভাব নিয়ে বড় হয়েছি। এটা কিনলে ওটা কেনা যেত না এটা তো বহু আগ থেকেই প্রচলিত ছিল আমাদের পরিবারের।

তবে তিন বেলা খাবার খাওয়ার পর কিছু টাকা সঞ্চয় করা যেতো। হায় কপাল বর্তমানে সঞ্চয় তো আকাশ-কুশুম কল্পনা। নূন আনতে যেখানে পান্থা ফুরায় সেখানে আবার সঞ্চয়। বাংলাদেশ বহু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে টিকে থাকা একটি দেশ। এর ইতিহাস ছিল লড়াই আর লড়াই।

হারের চেয়ে জিতেছে এ জাতি বেশী। কিন্তু বর্তমানে কেমন যেন হতাশায় ডুবে আছি। এত গল্প করার কি দরকার। মূল কথা হচ্ছে আয়ের সাথে ব্যয়ের মিল খুঁজে পাচ্ছি না। হুট-হাট দ্রব্যমূল্যের দামের উর্ধগতির ফলে কিছুটা বিপাকেই আছে জনগন। তবে এর বেশীরভাগ প্রভাবটা পড়ছে মধ্যম এবং নিন্ম আয়ের লোকদের মাঝে।

জাতি হিসেবে আমরা বীরের জাতি হলেও আমাদের মাঝে বীরত্ব বলে কিছু নেই। নিজে খাও নিজে বাঁচো নীতিতে আছি বলেই হুটহাট করে মানুষের উপর বোঝা চাপিয়ে দেই আমরা। এ দেশের ব্যবসায়ীরাও সুযোগ সন্ধানী। সুযোগ পেলেই বাড়িয়ে দিতে জানে। বেশী মুনাফা লাভের আশায় জনগনের ভোগান্তী তৈরিতে ও পারদর্শী তারা।

বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী হতে শুরু করে কোনটার দাম বাড়েনি বলেন। হ্যাঁ, বাড়েনি মানুষের দাম। সবজির বাজারে যাওয়া যায় না, মুদি দোকানে যাওয়া যায় না। মাছের বাজারে আগুণ, মাংসের কথা বাদ ই দিলাম। গত সপ্তাহের কথা ই বলি। হুট করে তেলের দাম বাড়ানো হলো অতিমাত্রায়।

পেট্রল, অকটেন, ডিজেল আর কেরোসিন এক লাফে সেঞ্চুরি করে ফেললো। ব্যবসায়ীরা খুশিতে ফিলিং স্টেশন বন্ধ করে ছুটলো। ঈদের উপর শক্রবার! লাভ আর লাভ। আর এদিকে মধ্যবিত্তের হার্টবিট বেড়ে গিয়েছেলো ততক্ষণে।

তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বাড়ানো হলো গাড়ি, লঞ্চ ভাড়া। এতেই কি ক্ষান্ত নাকি? সবাই সুযোগ বুঝে নিজেদের পণ্যের দাম উছিলায় বাড়িয়ে দিল কয়েকগুণ। আর সব বোঝা এসে পড়লো মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। সব কিছু বাড়ে, বাড়ে না মধ্যবিত্তের রুটি-রুজি।

বেতনভূক্ত মধ্যবিত্ত তো আরো যাতাকলে। সব বাড়ে, বাড়ে না বেতন। স্কিল যেখানে আছে সেখানেই থেমে থাকে। এদিকে মাস শেষে খরচের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে গিয়ে নীরবে চাপা কান্না করে। কে বুঝবে এ কষ্ট?

ও একটা কথা বলে রাখি। মধ্যবিত্তরা কিন্তু ভিনগ্রহের। এদের আত্মসম্মান খুব বেশী। এরা কারো কাছে ছোট হতে পারবে না, লজ্জায় নিজেদের গোপন অসহায়ত্বের কথা বলতে পারবে না, এরা বুক ফুলিয়ে বাঁচতে হবে, ঘরে ভাল খাবার নেই এটিও জনসমুক্ষে বলা যাবে না, কারণ সে মধ্যবিত্ত।

সমাজ তাকে ছোট হওয়ার সার্টিফিকেট দেয়নি। সে নীরবে-নীভৃতে মার খেয়ে যাবে চোখ বুঝে। করোনার পরে দেশে অনেক কিছু বদলেছে। বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। কর্মহীন হয়েছেন অনেকে। ঘুড়ে দাঁড়াতে পারেননি এমন মানুষের সংখ্যা ও বহুত।

আবার অপর দিকে কেউ কেউ সুযোগ বুঝে বনে গেছেন কোটিপতি। কর ফাঁকি থেকে শুরু করে ঋণখেলাপী কোনটা কমেছে দেশ থেকে? প্রতিটা সেক্টরে শুধু দুর্ণীতির আভাস। দিন শেষে লোকসানটা মধ্যবিত্তের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে খুশি কর্তৃপক্ষ।

মধ্যবিত্তের অবস্থা এখন কুলোর বলদের মত। ঘানি টানি, আর চুপষে যাই। মারছে মারুক, যা ইচ্ছা করুক, প্রতিবাদ করে লাভ কি? মাঝে মাঝে মনে হয়, এলিয়েনদের দেশে মধ্যবিত্তদের এক সময় আবাসস্থল হবে। কারণ এখানে টিকে থাকবে দূর্ণীতিবাজ, দালাল, তেলমারা শ্রেণি।

বাংলাদেশ মধ্যবিত্তের জন্য পারফেক্ট জায়গা নয়। এটা এখন বড়লোকের দেশ হয়ে গেছে। এখানে টিকে থাকতে হলে চোখের লজ্জ্বা পকেটে রাখতে হবে। এখানে সব বাড়ে, শুধু বাড়েনা মধ্যবিত্তের জীবন যাত্রার মান। বাড়েনা মধ্যবিত্তের বেতন, বাড়েনা মধ্যবিত্তের সম্পদ। শুধু বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম আর এক বুক হতাশা।

লেখকঃ রিফাত কান্তি সেন
উন্নয়ন কর্মী