পরিবেশ রক্ষায় নগর কৃষির গুরুত্ব

নগর কৃষির গুরুত্ব

মো. আশরাফুল আলমঃ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। এই শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০। ঢাকামুখী মানুষের স্রোত প্রতিদিনই বাড়ছে। ফলে দিনকে দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ।

গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর নগরবাসী তেমন একটা শীত টের পাচ্ছেন না। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে ফাঁকা ছাদ, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে দিন দিন পরিবেশ বিপর্যয়ের কারনে শীতকালে তেমন একটা শীত অনুভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করতে হলে প্রচুর পরিমানে গাছ লাগানো প্রয়োজন। যেহেতু সমতলে গাছ লাগানোর জায়গা তেমন একটা নেই, সেহেতু বাড়ির ছাদে ও ব্যালকনিতে সঠিকভাবে বাগান করা হলে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা শহরের কংক্রিটের কাঠামো মূলত শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যহত করছে। অধিক জনসংখ্যা, অতিরিক্ত নগরায়ন, যানবাহন, জলাধার ও গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে ঢাকার পরিবেশ দূষণ বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় অনেক বেশি৷ ঢাকা শহরের গাছপালার পরিমাণ ১৯৮৯ সালে ছিল ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে কমে ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে৷ অন্যদিকে ঢাকা শহরের বাৎসরিক গড় তাপমাত্রা ১৯৮৯ সালে ছিল ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিন্তু এটি ২০০৯ সালে বেড়ে দাড়িয়েছে ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ আর এই বছর কত হয়েছে সেটা আমরা প্রায় সবাই জানি।

ঢাকায় মাটি ও খোলা যায়গার অস্তিত্ব দিনকে দিন কমে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে খোলা জায়গা। বাড়ছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। ইট-কাঠের বদলে দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো ও কাচে মোড়ানো বহুতল ভবন। বাণিজ্যিক ভবনগুলোর টেকসই স্থাপনা ও দৃষ্টিনন্দনের বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবহার করা হচ্ছে হালকা, কিন্তু শক্তিশালী ধাতব পাত, ফাইবার ও গ্লাস। এতে করে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে কেননা, সূর্য থেকে তাপ ও আলো ধাতব ও কাচের কাঠামোর একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হয়। বারংবার প্রতিফলনের কারণে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় সামান্য বেড়ে যায় এবং শহরজুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য হিট আইল্যান্ড বা তাপ দ্বীপ।

এদিকে ঢাকার বাহিরে যে পরিমান বনায়ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে তার তুলনায় ঢাকাতে সেটা অপ্রতুল। যে পরিমাণে গাছ কাঁটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। গাছ শুধুমাত্র কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে মানুষকে বাচায় না বরং বৃষ্টিপাত ঘটাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, গাছের পাতা, ডাল, বাকল, নানান ধরনের ঔষধ হিসাবেও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে গরমকালে একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং অন্যদিকে শীতকালে ঠান্ডার পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে সাথে পরিবেশ পড়ছে হুমকির মুখে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ছাদবাগান আছে এইরকম দালানের কক্ষের ভেতরের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ১.০ থেকে ১.২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত কমায়। এমনকি ঘরের বারান্দায় যাদের বাগান আছে তাদের ঘরের ভীতর থেকে বারান্দার তাপমাত্রা কম থাকে। এছাড়াও ছাদবাগান করার কারনে আশেপাশের এলাকায় কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান প্রায় ৭০ পিপিএম পর্যন্ত কমে যায়। যদি ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ছাদবাগানের প্রসার করা যায়, তবে এটি একদিকেন যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য বায়ু দূষণকারী উপাদানের মাত্রা কমিয়ে পরিবেশ দূষণ কমাবে এবং অন্যদিকে আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া নগর কৃষির মাধ্যমে শহরের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে জাতীয় উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

প্রসঙ্গত, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ তে বিশেষায়িত কৃষির আওতায় ছাদকৃষির প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ছাদবাগান স্থাপনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও আর্থিক ও কারিগরি সহায়তাও বেশ জরুরি। সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ছাদবাগান সম্প্রসারণের কৌশল নির্ধারণ করাও প্রয়োজন। ছাদ বাগান ও নগর কৃষির জন্য সরাকারে পাশাপাশি বেসরকারী কৃষিজ প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নানান ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখকঃ পরিবেশকর্মী ও ‘গো ইউথ আশরাফুল আলম’ নামক ইউটিউব চ্যানেলের কন্টেন্ট ক্রিয়েটর