শেয়ারবাজারে সমাপ্তি বছরে আলোচিত যা কিছু

শেয়ারবাজার ২০২১

মহকালের পাতায় স্মরনীয় হয়ে থাকবে আরও একটি বছর ২০২১। দীর্ঘদিনের আশা সঙ্কটসহ করোনার আঘাত মোকাবিলা করে সমাপ্তি বছরে শেয়ারবাজারকে ইতিবাচক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসইসি) নতুন কমিশন। এই কমিশনের উদ্যোগে বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসায় ফিরেছে গতিশীলতা৷ ফলে বেড়েছে নতুন বিনিয়োগকারীও ৷ প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় দেশের প্রধান শেয়ারবাজারে লেনদেন গেলো ১০ বছরে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। অনুরূপভাবে লেনদেনের সাথে সমন্বয় রেখে বৃদ্ধি পেয়েছে সূচকও।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জিরো টলারেন্স নীতিতে গেলো বছরে শেয়ারবাজারে এসেছে ইতিবাচাক পরিবর্তন। সময় যত যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের ভুমিকা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তালিকাভুক্ত দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিও এখন তালিকাভুক্ত হচ্ছে শেয়ারবাজারের।

সমাপ্তি বছরের আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে আজকের আয়োজন:

  • নতুন আইপিও পদ্ধতি :

২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে পুরনো লটারি প্রথার আইপিও পদ্ধতি বাতিল করে আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনা হয়। নতুন পদ্ধতিতে আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে আইপিও আবেদনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য একজনকে সেকেন্ডারি মার্কেটে ২০ হাজার টাকার শেয়ার কিনতে হয়। যদিও এর আগে শেয়ারবাজারে এ নিয়ম ছিল না।

সেনা কল্যাণ ইন্সুরেন্সের আইপিওর মাধ্যমে আইপিওতে সর্বোচ্চ চাঁদা জমার হারে পরিবর্তন আনা হয়। আইপিওতে নতুন নিয়ম প্রর্বতনের শুরু থেকেই একটি কোম্পানিতে একজন বিনিয়োগকারী সর্বনিম্ন ১০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আবেদন করতে পারতো। এতে পরিবর্তন করে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

  • ওটিসি মার্কেট বাতিল:

২০২১ সালে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ওটিসি মার্কেট (ওভার দ্য কাউন্টার) বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেয়। ওটিসি মার্কেটে থাকা কোম্পানির শেয়ারগুলোর মধ্যে ২৩টি কোম্পানিকে স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে ও ১৮টি কোম্পনিকে এটিবিতে (অল্টারনেটিভ ট্রেডিং প্লাটফর্ম) এবং ওটিসির বাদবাকি শেয়ারগুলোকে মার্কেট থেকে তালিকাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

ওটিসির ৪টি কোম্পানি স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে লেনদেন শুরু করেছে। কেম্পানিগুলো হলো বেঙ্গল বিস্কুট, ওয়ান্ডার টয়েজ, আ্যপেক্স ওয়েভিং এন্ড ফিনিশিং মিলস, এবং হিমাদ্রি লিমিটেড। স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে শুধুমাত্র যোগ্য বিনিয়োগকারীরাই লেনদেন করতে পারেন।

  • স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্ম চালু:

দেশের প্রধান শেয়ারবাজারে ২০২১ সালে লেনদেনের নতুন প্লাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করে এসএমই প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্ম সবার জন্য উম্মুক্ত নয়। শুধুমাত্র যোগ্য বিনিয়োগকারীরাই এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন।

গেলো বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ওটিসির ৪টি কোম্পানিসহ ৬ কোম্পানি স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে লেনদেন শুরু করে। কেম্পানিগুলো হলো বেঙ্গল বিস্কুট, ওয়ান্ডার টয়েজ, আ্যপেক্স ওয়েভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলস, হিমাদ্রি লিমিটেড, মাস্টার ফিড এগ্রোটেক এবং অরিজা এগ্রো। স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্ম সবার জন্য উম্মুক্ত নয়। এই প্লাটফর্মে শুধুমাত্র যোগ্য বিনিয়োগকারীরাই লেনদেন করতে পারেন।

  • মার্জিন ঋণের শর্ত শিথিল:

২০২১ সালে মার্জিন ঋণ প্রদানের শর্ত শিথিল করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এর আগে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তন হলে ৩০ কার্যদিবস পর্যন্ত মার্জিন ঋণ সুবিধা না পাওয়া গেলেও এখন থেকে ক্যাটাগরি পরিবর্তন হলেও শর্ত সাপেক্ষে মার্জিন ঋণের সুবিধা পাওয়া যাবে।

বিএসইসি নিয়ম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তন হলে পরবর্তী ৩০ কার্যদিবস সেই কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের জন্য বিনিয়োগকারীরা মার্জিন ঋণের সুবিধা পাবেন না। এই শর্ত সব ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর এমন আইন জারি করেছিল বিএসইসি।

নতুন সিদ্ধান্তের ফলে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির ক্যাটাগরির উন্নতি হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের জন্য এখন থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যেও মার্জিন ঋণ সুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। তবে ক্যাটাগরির অবনতি হলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না। আর ‘জেড’ এবং ‘এন’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর শেয়ার ক্রয়ের জন্য কোনোভাবেই মার্জিন ঋণ পাবেন না বিনিয়োগকারীরা।

  • বছরজুড়ে শেয়ারবাজারের নতুন তালিকাভুক্তি:

২০২১ সালে প্রাথমিকগণ প্রস্তাব বা আইপিওতে আসা ১৩টি কোম্পানি ২৫৮৬ কোটি ৯ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়৷ সূত্রমতে, ২০২১-এ শেয়ারবাজারে নতুনভাবে তালিকভূক্ত হওয়া এসব কোম্পানির মধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির অনুকূলে তালিকাভূক্ত হয়েছে ৫টি কোম্পানি। আর ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতিতে বাজারে এসেছে ৮টি কোম্পানি। ১০৪৬ কোটি টাকার মধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির পাঁচ কোম্পানিই বাজারে এনেছে ৭০০ কোটি টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলো হলো: বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার, ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড, মীর আক্তার হোসেন এবং এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড।

আর ২০২১-এ ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতির আটটি কোম্পানি বাজারে এনেছে ৩৪৬ কোটি টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলো হলো: একমি পেস্টিসাইডস, সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ই-জেনারেশন এবং তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

  • ডিএসইএক্সের ৭ হাজারের মাইল ফলক স্পর্শ:

২০২১ সালে প্রথম বারের মত ৭ হাজারের মাইল ফলক স্পর্শ করে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার। গেলো ৫ই সেপ্টেম্বর রবিবার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস শেষ হয় ৭ হাজার ৫২ পয়েন্ট নিয়ে। ২০১৩ সালের ২৭শে জানুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক চালুর পর এটিই ছিল সর্বোচ্চ সূচকের রেকর্ড। উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই বাড়তে থাকে সূচক। লেনদেন ও সূচকের ইতিবাচক প্রবনতায় ডিএসই’র বাজার মূলধনও গেলো বছরেই ছাড়িয়ে যায় রেকর্ড ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা।

  • ডিএসইর বিশ্বসেরার হ্যাট্রিক করার রেকর্ড:

বিশ্বের সব শেয়ারবাজারগুলোকে পেছনে ফেলে ছয় মাসের ভিতরে তৃতীয়বারের মতো সেরা তালিকায় স্থান করে নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মে মাসে রিটার্নের দিক দিয়ে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের সেরা শেয়ারবাজারের স্থান দখল করে।  বিশ্বের সেরার খেতাব অর্জনে হ্যাট্রিক করার রেকর্ড অর্জন করে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার।

ফ্রন্টিয়ার জার্নাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচ্য সময়ে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের শেয়ারবাজার থেকে রিটার্ন পেয়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া পাকিস্তান ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম ৭ দশমিক ২ শতাংশ, চায়না ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ফিলিপাইনস ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, কাজাকিস্তান ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২ দশমিক ৫ শতাংশ, থাইল্যান্ড শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে রিটার্নের দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা শেয়ারবাজার তালিকায়ও উঠে আসে ডিএসইর নাম।

  • ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ১১৩৭.৬৯ পয়েন্ট:

সমাপ্তি বছরের ৩ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৬১৮.৯৬ পয়েন্টে। গেলো ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করে ৬৭৫৬.৬৫ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের মধ্যেই ডিএসইএক্স সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে ১১৩৭.৬৯ পয়েন্ট। তবে ২০২১ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডিএসইক্স সূচক ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়ে।

২০২১ সালে ডিএসইএক্স মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ৭৩৬৮.০০ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ৫০৪৪.৯৯ পয়েন্ট৷ ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ৪,০৯০.৪৭ পয়েন্ট নিয়ে এ সূচকের যাত্রা শুরু হয়৷

এদিকে সমাপ্তি বছরের ৩ জানুয়ারি ডিএসইর ডিএসইএস সূচক ছিল ১২৯৯.৫২ পয়েন্ট। গেলো ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইএস সূচক অবস্থান করে ১৪৩১.১২ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক বেড়েছে ১৩১.৬ পয়েন্ট।

৩ জানুয়ারি ডিএসইর ডিএসই–৩০ সূচক সূচক ছিল ২০৭৮.৯৫ পয়েন্ট। গেলো ৩০ ডিসেম্বর ডিএসই–৩০ সূচক সূচক অবস্থান করছে ২৫৩২.৫৮ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক বেড়েছে ৪৫৩.৬৩.৭৮ পয়েন্ট।

  • বেসরকারি সুকুক বন্ডের প্রচলন :

সমাপ্তি বছরে শেয়ারবাজারে শরীয়াহ ভিত্তিক বেসরকারি সুকুক বন্ডের প্রচলন শুরু হয়। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো লিমিটেড ৫ বছর মেয়াদি সুকুক বন্ডের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এ টাকায় বেক্সিমকো তাদের টেক্সটাইল ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বেসরকারি পর্যায়ে এটিই প্রথম সুকুক বন্ড।