শান্তি প্রতিষ্ঠার অবিরাম সংগ্রামে অনন্যোপায় হয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নিতে
হয়েছে কখনো কখনো মহানবী সা:-কে। তিনি যুদ্ধ ও রক্তারক্তির বীভৎস কাণ্ড
পছন্দ করতেন না ঠিক, কিন্তু মানবদেহের কোনো অঙ্গে পচন ধরলে যেমন পুরো দেহ
রক্ষার্থে সে অঙ্গটি কেটে ফেলা অপরিহার্য হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বে
শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যেসব অপশক্তি বাদ সেধেছিল তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র
ধারণে কুণ্ঠিত হননি তিনি। তার যুদ্ধগুলো প্রচলিত সামরিক অভিযান ছিল না,
সাম্রাজ্য বিস্তার বা ধন-সম্পদ উপার্জন ছিল না। বেশির ভাগ যুদ্ধই ছিল
মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল
প্রতিরোধমূলক।
মহানবী সা:-এর যুদ্ধনীতি ছিল ‘কখনো যুদ্ধের আকাক্সক্ষা
পোষণ করো না, নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হও’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
তিনি তাঁর সাহাবিদেরকে বলতেন, ‘তোমরা নির্দোষ মহিলা, শিশু এবং অসমর্থ
বৃদ্ধদেরকে হত্যা করো না। কোনো শত্রুকে আগুনে ফেলে মেরো না। ফলন্ত বৃক্ষ
কেটো না কিংবা পরাজিতদের সম্পত্তি নষ্ট করো না’ (আবু দাউদ)।
মহানবী সা:
সামরিক জীবনে কতটা শান্তিকামী ছিলেন তা এ সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে মোটামুটি
অনুমান করা যায়। মূলত তাঁর যুদ্ধ ছিল একান্তভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান
লক্ষ্যে। অনর্থক রক্তক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না তাঁর সমরনীতিতে। তাই তিনি এমন
পরিকল্পনা ও কৌশল অবলম্বন করতেন, যাতে অল্প লোকক্ষয়ের মাধ্যমেই উদ্দেশ্য
সিদ্ধ হয়। তাঁর সব যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি সুস্পষ্ট
হয়ে ওঠে। তিনি ২৭টি যুদ্ধে (গাজওয়া) নিজে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ৫৬টি যুদ্ধে
(সারিয়া) তাঁর প্রেরিত ব্যক্তিরা লড়াই করেছেন। এ যুদ্ধগুলোতে উভয় পক্ষের
নিহতের সংখ্যা কেবল ১০১৮ জন। অথচ এরই মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছিল আরব সভ্যতার
সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণবাদী বিপ্লবের। সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সত্য ও
শান্তি। বিশ্ব ইতিহাসে এহেন বিপ্লবের নজির দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না।
মুহাম্মদ
সা: যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর হাতে একজন অমুসলিমও নিহত হয়নি।
তরবারি ব্যবহারের চেয়ে ক্ষমাই তাঁর যুদ্ধনীতির মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ
করেছে। তাঁর নির্দেশনা ছিল, যুদ্ধে শিশু, বৃদ্ধ, নারী তাদের বিরুদ্ধে
মুসলিম বাহিনী যেন কোনো অস্ত্র না ধরে। সম্পদ, তা শত্রুদেরই হোক না কেন,
নষ্ট না করতে তাঁর আদেশ সব সময়ই কাজ করত। মৃত শত্রুদের বিকলাঙ্গ করা তাঁর
নীতিবিরুদ্ধ কাজ ছিল। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সব সময়ই মানবিক ব্যবহার তাঁর
সমরনীতির অত্যাবশ্যকীয় অংশ ছিল। শত্রুপক্ষের কাছ থেকে সন্ধি বা শাস্তির
প্রস্তাব এলে যুদ্ধ থেকে একেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। শান্তিচুক্তি কখনো ভঙ্গ
করেননি।
এভাবে মহানবী সা: প্রথম আরব ভূখণ্ডে মানবতার সামগ্রিক জীবনে
শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গোটা বিশ্বের সামনে ইসলামের একটা শান্তিময় মডেল
পেশ করেন। মূলত এ ছিল গোটা বিশ্বের প্রতি সত্যের আহ্বান। সারা পৃথিবীতে
সত্য ও শান্তির প্রদীপ্ত পয়গাম ছড়িয়ে দিতে তিনি তদানীন্তন বিশ্বের
শক্তিশালী নায়কদেরও সত্যের আহ্বান জানিয়ে দূত মারফত পয়গাম পাঠিয়েছিলেন।
আবিসিনিয়া, রোম, পারস্য প্রভৃতি রাষ্ট্রের নায়কদের প্রতি তিনি পত্র
দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই ধীরে ধীরে সত্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। এভাবে
এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দিকে দিকে শান্তির পয়গাম ছড়িয়ে পড়েছিল। মহানবী
সা:-এর সেই আহ্বানে তিনটি মহাদেশেই এক অপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। পৃথিবীর
খ্যাতনামা সম্রাট ও বীরগণ রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে যা করতে সক্ষম হননি, আরবের
উম্মি নবী সা: শুধু তাঁর বাণী দ্বারাই তা সম্পন্ন করেছিলেন। আর এখানেই
মহানবী সা:-এর বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য।
অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের
মধ্য দিয়ে মহানবী সা:-এর সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা বিপ্লবের সফল উত্তরণ ঘটে।
সীমাহীন অত্যাচারী মক্কাবাসী ভেবেছিল আজ আর কারোর রক্ষা নেই। কিন্তু
শান্তির নবী সে দিনও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। নিরাপত্তা দিয়েছিলেন
একুশ বছর যাবত জ্বালাতনকারী ও স্বদেশ থেকে বিতাড়নকারী মানুষগুলোকে,
বিশ্ববিবেক এখানে স্তম্ভিত, বিমূঢ়। এও কি কোনো মানুষ দ্বারা সম্ভব! মানুষের
আত্মা কী করে এত বিশাল হয়!! ঐতিহাসিক গিবন বলেছেন, ওহ ঃযব ষড়হম যরংঃড়ৎু ড়ভ
ঃযব ড়িৎষফ ঃযবৎব রং হড় রহংঃধহপব ড়ভ সধমহধহরসরঃু ধহফ ভড়ৎমরাবহবংং যিরপয পধহ
ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয ঃযড়ংব ড়ভ গঁযধসসধফ যিবহ ধষষ যরং বহবসরবং ষধু ধঃ যরং ভববঃ ধহফ যব
ভড়ৎমধাব ঃযবস ড়হব ধহফ ধষষ.
আবহমানকাল ধরেই যুদ্ধ চলে আসছে এই পৃথিবীতে,
যুদ্ধ চলছে আজো এবং চলতে থাকবে। কিন্তু এর মাঝেও যে মানবিক চেতনার প্রতিফলন
ঘটতে পারে এবং শান্তির পথ উন্মুক্ত হতে পারে মহানবী সা: মক্কা বিজয়ের মধ্য
দিয়ে সে সবক দিয়ে গিয়েছিলেন গোটা মানব জাতিকে। আজকের সঙ্ঘাতময় পৃথিবীতে সে
শিক্ষার যথার্থ অনুসরণ বড় বেশি জরুরি হয়ে পড়েছেÑ এর প্রয়োজন প্রথমত আমাদের
জাতীয় জীবনে। প্রতিহিংসার রাজনীতি এ যুগে আমাদের জীবনকে যেমন পর্যুদস্ত
করছে, তেমনি দারুণভাবে আহত করছে জাতীয় আদর্শ ও নৈতিকতাকে। নবীজী সা:-এর
আদর্শকে বাস্তবায়নই পারে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে স্বস্তি দিতে।
লেখক : প্রবন্ধকার
মূল পাতা আন্তর্জাতিক