‘দর্পিত-দাপটের পরাজয়’ এডভোকেট মিজান

দর্পিত-দাপটের পরাজয়
‘দর্পিত-দাপটের পরাজয়’

বিশ্ববিদ্যায়ের লম্বা ছুটি। বাবা মায়ের সান্যিধ্যে বাঁধ ভাঙ্গা অকৃত্রিম আনন্দের অনুভব অন্যরকম। শৈশবের বন্ধুদের মিলন মেলায় স্কুল ক্যাম্পাস উৎসবে সরব। আজ স্কুলের বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতার নির্ধারিত দিন।প্রাক্তন ছাত্ররা সকলে নিমন্ত্রিত। স্কুলের ছাত্র ছাত্রী সকলে রঙ্গিন সাজে সাজসজ্জায় মুখরিত।প্রাক্তন ছাত্রী তাহমিনা চৌধুরীর আগমনে ছাত্র শিক্ষক প্রাক্তন ছাত্ররা সকলেই আনন্দিত।

তাহমিনা অত্র বিদ্যাপিঠের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হিসাবে সকলের মুখে মুখরিত। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত তৃতীয় শ্রেনীতে উত্তির্ন বখিয়ে যাওয়া কতেক প্রাক্তন ছাত্র ব্যাতিত সকলেই তাহমিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।তাহমিনাই এই স্কুলের একমাত্র ছাত্র যে ম্যাডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।ঢাকা ম্যাডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে তার সুগন্ধি ছড়াতেই তাহমিনার স্কুলে আগমন।

আমি যখন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এস এস সি পরীক্ষায় উত্তির্ন হই, তখন তাহমিনা অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী ছিলেন। দু’জনই স্কুলের সেরা ছাত্র এই কৃতিত্ব ছাড়া আমার আর সমান তালে কোন গুন ছিলো না। তাহমিনার বাবা দীর্ঘদিন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।

স্কুলের দাতা শ্রেনীভূক্ত হওয়ায় তাদের ভাবগম্ভীর্য আচরনেই স্কুলের শিক্ষকরাই আতঙ্কিত থাকে। তাহমিনা যতই সুন্দরী হউকনা কেন কোন ছেলেই তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাহস ছিলোনা। আমার ডানপিটে দুরান্তপনা আচরনে তাহমিনা হতবাক। আমার নির্ভয়ে তাহমিনাকে প্রতিদিন স্কুলে অনুসরন করার সাহস দেখে তাহমিনা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে যেতো। ক্লাশের অন্য মোয়েরা আমাকে তাহমিনার কাছাকাছি ঘুরপাক খাওয়ার আচরন দেখেই হাসাহাসিতে মশগুল থাকতো।

আমার বাবা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হলেও জ্ঞানভান্ডারে পরিপূর্ন একজন আদর্শ মানুষ। তাহমিনার বাবাকে গ্রামের সকল মানুষ মান্য করতে বাধ্য। অর্থবিত্ত সামাজিক খ্যাতি আর বুনিয়াদী পারিবারের ঐতিহ্যই তাদের সম্পদ। আমার বাবার প্রাজ্ঞতা আর শিরদাঁড় করা স্বভাব তাহমিনার বাবা আজাহার উদ্দিন চৌধুরীর পচন্দনীয় ছিলো না। বাবাকে অপচন্দের কারনে আজহার সাহেবের চোখে আমি চক্ষুশুল ছিলাম।

মাথা নেড়ে কোন দিন আমার সালামের জবাব দিতে চাইতেন না। তাহমিনার কারনে আমি অকারনে আজাহার চাচার আপন হতে চাইলেও তিনি আমাকে দেখলেই কোন খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতির সম্মান প্রত্যাখান করতেন। বন্ধুরা আমাকে বিদ্রুপ করে বলতেন আমাকে দেখতে স্মাট হলেও কোন দিন নাকি আমার আশা পুরন হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে আমি আমার জীবনের শক্তির সন্ধান পেতে থাকি। ধীরে ধীরে পৃথিবীকে গ্রাম বলেই মনে হতে লাগলো। অর্থনৈতিক দৈন্যতা মানুষকে অনেক ছোট করে রাখে। মাথা উঁচু করে কথা বলার শক্তি নষ্ট করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের নৈতিক ভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সজিব করে তোলে। তাহমিনাকে দেখে আমার সজিব হওয়া হৃদয় কেঁপে উঠে।

তাহমিনার অহংবোধের অসুন্দর গৌরবিত মুখমন্ডল তার ম্যাডিকেল পড়ার সৌন্দর্য্য নষ্ট করে দিয়েছে। মাটিতে পা পড়তেই তার অনেক কষ্ট হয়। বাবা বড় লোক,স্কুলের ম্যানিজিং কমিটির সভাপতি, ভালো ছাত্রী, তেমনি সুন্দরী, সবশেষে ডাক্তারী পড়া। একগুলো গৌরভ ধারন করার জায়গা তাহমিনার শরীরে ছিলো না। তাহমিনার অবয়ব দেখে আমি নিজকে তুলনায় ডাস্টবিন ভাবতে থাকি।

দর্শক চেয়ারে বসেই প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা সকলেই ছেলে মেয়েদের ক্রিয়া প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে থাকি। আগবাড়িয়ে তাহমিনার কুশলদী জিজ্ঞাসা করি। তাহমিনার পরনের লাল শাড়িতে তাকে সুন্দর লাগছিলো। এমন অভিব্যাক্তি তাকে প্রকাশ করেছিলাম। সে কিছুক্ষন নিরুত্তর থেকে প্রতিউত্তরে আমাকে আক্রমন শুরু করলো, আমার মত বেয়াদব এই অঞ্চলে একজনও নেই। আগবাড়িয়ে আমার খবর নেওয়া আপনার কি দরকার।

তাহমিনার মেয়ে বন্ধুদের বিদ্রুপের হাসাহাসিতে আমি অপমান বোধ করি। তাৎক্ষনিক উত্তেজিত অসংবেদনশীল মুখ থেকে বেরিয়ে আমি ” এই রকম মহিলা ডাক্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কাজের মেয়ে হিসাবে বাসায় রাখে না। এমন একটি অসংলগ্ন বাক্য আমার জীবনকে তছনছ করে দিবে তাহা আমার জানা ছিলো না। একজন ম্যাডিকেল কলেজের ছাত্রীকে কাজের মেয়ের সাথে তুলনা করার সাথে সাথে এক ভয়াভহ ভূমিকম্পের মত শুরু হলো।

তাহমিনা চিৎকার দিয়ে শিক্ষকদেরকে জড়ো করলেন। কঠিন বিচার চাই নচেৎ সঠিক জবাব দিবে। চারিদিকে হইচই শুরু হলো। স্কুলের ছেলে মেয়েরা খেলাদুলা বন্ধ করে তাদের স্কুলের সেরা দু’জন প্রাক্তন ছাত্রের অশালীন আচরন প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। সভাপতি সাহেবের মেয়েকে ইভটিজিং করার মত লেকের জিব্বা কেটে ফেলতে হবে। প্রধান শিক্ষক ভয়ে কম্পমান। খেলাদুলার অনুষ্ঠান বাতিল করা হলো।

তাহমিনার পক্ষে আকাশ বাতাস একাকার হলো। আনন্দঘন সুন্দর অনুষ্ঠানটি আমার কারনে ভন্ডুল হওয়ায় আমি দারুণ ভাবে মর্মাহত হই। তাহমিনা আমার অভদ্রসুলভ শব্দটি অন্যত্র প্রকাশ করবে এমন ধারনা আমার ছিলো না। আমি বৈরি পরিবেশ দেখে বাড়ীতে এসে বাবাকে সত্য ঘটনা প্রকাশ করি। বাবা আমাকে অভয় দিলেন। আমি নাকি গুরুতর কোন অপরাধ করিনি। তাহমিনার বাবা দুষ্ট মোড়ল হলেও এত খারাপ নয় যে অধর্তব্য অপরাধের জন্য এই বিষয় নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবে।

বাবা আমাকে তাহমিনার বাবার নিকট ক্ষমা চাওয়ার জন্য আমাকে তাদের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বললেন। আমি অপরাধ চিত্তে চৌধুরী বাড়ীতে হাজির হলাম। বাড়ী ভর্তি মানুষ দেখে আমি বিস্মিত হই। চৌধূরী চাচা এতই উত্তেজিত যে দু’জন চামচা তাকে মাথায় তেল পানি দিয়ে শান্ত করছিলেন। আমাকে দেখে চৌধুরী চাচা অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে লাগলেন।আমি ক্ষমা চাইলাম, তিনি বললেন ক্ষমা করবে আদালত।

চারিদিক থেকে পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেলে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গাড়ীত তোলেন। আমি অনেকবার চিৎকার দিয়ে বলতে চেয়েছি সামনেই আমার পরীক্ষা। পুলিশ আইনের নিয়ন্ত্রনে না থেকে চৌধুরী চাচার নিয়ন্ত্রিত দেখে আমি স্তম্ভিত হই। তাহমিনার মা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।এই বয়সে ছেলে মেয়েদের অনেক কথা হয় তার জন্য ছেলেটার সাথে এরকম নিষ্ঠুর আচরন করা সঠিক নয়। তাহমিনাকে আমি চোখ দিয়ে খুজে না পেয়ে হতাশ হই। পুলিশের সাফ জবাব অভিযোগের বিচার করবে আদালত।

নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ ( সংশোধিত ২০০৩) আইনে মিথ্যা বাড়তি অভিযোগে আমাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপার্দ করা হলো। এই আইনে অপরাধের জামিনের ক্ষমতা ম্যাজেষ্ট্রেটের না থাকায় আমাকে কারাগারে প্রেরন করা হলো। আমার অপরাধের শাস্তির কষ্টের চেয়েও সম্মান নষ্টের কষ্ট বেদনা দায়ক ছিলো। আমার পরিবারের সদস্যরা মানসীক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার একমাত্র ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে আমার জামিনের জন্য চেষ্টা করতে থাকলো।

একমাস পর জেলা ও দায়রা জজ বাহাদুর আমার জামিন মঞ্জুর করেন। আমার বাবা আমাকে নির্দোষ ঘোষনা করে বুকে ঝড়িয়ে ধরেন। আমার বাক রুদ্ধ হয়ে পড়লো। এমন নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আমাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুললো। আমার শিক্ষককে জানালে তিনি তাঁর ছাত্র পুলিশের ডি আই জি এর সাথে কথা বললেন। মিথ্যা অভিযোগের চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

আমার জীবনে আমার শিক্ষা, পারিবারিক অর্থনৈতিক দৈন্যতা , তাহমিনার বাবার প্রতিপত্তি ,খ্যাতি ,অহংকার , আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী, রাষ্ট্রের আইন, আইনগত আদালতের ক্ষমতা, অপরাধীদের জন্য কারাগার, তাহমিনার প্রতি ভালোবাসার অনূভব,একজন দুষ্ট মোড়লের দাপট, তাহমিনার আদর্শময়ী মা,আমার আদর্শিক বাবা, স্কুলের নতজানু শিক্ষক মন্ডলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত আকাশ এই সকল কিছুর অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সাথে সংযুক্ত হলো। জয় পরাজয়ই সত্য আর মিথ্যার মাপকাঠি।

আমার জীবনে একটি মাত্রই পথ খোলা সেই পথ জয়ের পথ। জয় দিয়েই রক্তপাত হীন প্রতিশোধের প্রতিশেধক আবিস্কার করতে হবে। শিক্ষাই আলোর প্রদীপ, এই প্রদীপ জ্বালানো ব্যাতিত আমার আর কোন পথ খোলা ছিলো না। অনার্স-মাষ্টর্সে প্রথম হয়েছি।বি সি এস পরীক্ষাই আমার জীবন-মৃত্যুর মাপকাঠি।
একদিন ভোরের সূর্য আমার জীবনের কালো অন্ধকার সরিয়ে আলোকিত করে দিলো।আমি বি সি এস পরীক্ষায় উত্তির্ন হয়েছি। মেধা তালিকায় পুলিশ বিভাগে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ এস পি হিসাবে আমার প্রথম কর্মস্থলে যোগদান। আমার দুই কাঁধে তারকা খচিত স্টার রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আমি মানুষের সেবায় নিয়োজিত শক্তির মালিক।

স্যালুট নেওয়া এবং দেওয়া আমার জীবনের সাথে সংযুক্ত হলো। ইউনিফর্ম পরে ডিপার্টমেন্টের গাড়ী যোগে বাড়ীতে এসে বাবা মায়ের পায়ের ধূলি নিলাম।স্কুলের শিক্ষক ছাত্র সকলেই একটি জীবন্ত গল্পেের নায়ককে বাস্তবে স্বচোক্ষে অবলোকন করলেন। অনেক দিন পর তাহমিনা আর তার বাবা ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে লঞ্চঘাটে যাওয়ার প্রাক্কালে আমার পুলিশের পাজেরো গাড়ীতে তুলে নিলাম। পোশাক আর সানগ্লাস পরনে থাকায় আমাকে চিনতে পারেনি শুধু নামার সময় আমার পরিচয় জানতে চেয়েছিলো, আমি নিঃশব্দে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে গন্তব্যে চলে যাই।

পিয়ন জানালেন সাদা ইউনিফর্ম পরে একটি মেয়ে আমার অফিসে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো, গুরুত্বপূর্ন একটি এন্টি টেরোরিজম কমিটির সভা থাকায় সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়ার সুযোগ ছিলোনা। একদিন বাবা ফোনে জানালেন তাহমিনার আম্মা অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু ম্যাডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমার অপ্রকাশিত ক্ষতস্থানের ব্যাথা নিবারনের জন্য চাচীকে দেখতে গিয়েছিলাম,ভদ্র মহিলা আমাকে নিঃস্বার্থ স্নেহের পরশে জড়িয়ে ধরলেন।

তাহমিনার বাবা নির্বাক অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনৈতিক দর্পিত-দাপটি মানুষ জীবনের কোন এক সময়ে পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়। নৈতিক ভালোবাসায় পরিশোধিত জীবনে কোন পরাজয় থাকে না। তাহমিনা কি যেন বলতে ছেয়েছিলো। আমি অন্য মনস্ক থাকায় তার কোন কুশলাদী জিজ্ঞাসা করিনি। একবার আগবাড়িয়ে কুশলাদী জিজ্ঞাসা করে কারাবরন করেছিলাম। নুতন কোন বিপদের কথা চিন্তা করে মহিলা ডাক্তারের সাথে আর কোন কথা হয়নি।