কোরআনের শ্রমনীতিতেই মানবতার মুক্তি

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের মেহনতি জিন্দেগীর কথা বলতে যেয়ে একদিন বলেছিলেন,দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোনো নবী পাঠাননি যিনি বকরী বা ছাগল চড়াননি। তখন সাহাবা-ই-কিরাম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘হুযুর! আপনিও!’

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন ‘হ্যাঁ, আমি দু’কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরি চড়িয়েছি।

নবী জামাতা হযরত আলী রা. এর শ্রমের কাহিনী তিনি নিজেই এভাবে বলতেন, ‘মদীনায় থাকাকালীন একবার ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শহরতলীর দিকে কাজের তালাশে বের হয়ে পড়লাম। এক স্থানে একটি মেয়েকে মাটি জমা করতে দেখতে পেলাম। মনে হলো সে হয়তো তা ভিজাবে। তখন একটি খেজুরের বিনিময়ে এক এক বালতি পানি তুলে দেওয়ার কাজে লেগে গেলাম। এভাবে ১৬ বালতি পানি তুললাম। এতে আমার হাতে ফোসকা পড়ে গেল। কাজ সেরে পানির কাছে গিয়ে হাত-পা ধুইলাম। মেয়েটি আমাকে ১৬টি খুরমা পারিশ্রমিক দিয়ে দিল। তা নিয়ে নবী সা.এর কাছে এলাম। সবিস্তার ঘটনা বর্ণনার পর নবী সা.ও আমার সঙ্গে তা খেলেন।’

এভাবে রাসুল সা. নিজে শ্রমিক হয়ে শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর সাহাবাগণকে শ্রমের প্রতি উদ্বুদ্ব করেছেন।

নবী করীম সা. ইরশাদ ফরমান-‘শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়’।

শ্রমজীবি মানুষদের ন্যায্য অধিকার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেরণায় প্রতি বছরের মতো এবারও ১লা মে পালিত হলো আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকেই বেচে থাকার তাগিদে পরিশ্রম করতে হয়। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে নানাভাবে আমরা সকলেই বিভিন্ন কাজে শ্রম দেয়। এ হিসেবে বলা যায়, মানুষমাত্রই শ্রমজীবী।আমরা জানি, মানবতার দীক্ষাগুরু আল্লাহর প্রেরীত নবীগন কখনও নীচ কাজ করতে পারেন না।

উপার্জন করা পরিজনদের ভরণ-পোষণের নিমিত্তে প্ররিশ্রম করা ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদের মতোই। ঈমানের ঝাণ্ডা নিয়ে মাঠে ময়দানে ব্যাকুল প্রতীক্ষায় ঘুরে বেড়ানোর মর্যাদায় এ অভিষিক্ত।

এক সাহাবীর প্রশ্নের উত্তরে রাসূল স. বলেন,‘নিজের পরিজনদের নিমিত্ত হালাল রুজি উপার্জনে ব্যাপৃত থাক; কেননা নিশ্চয় এটি আল্লাহর পথে জিহাদ করার মতোই’। একজন মুমিনে কাছে এর চেয়েও আবেদনময় বাণী আর কী হতে পারে?

উপার্জনের দিকে উৎসাহিত করে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,‘যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয়ে যায়,তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়; আর আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে ব্যাপৃত হয়ে যাও’।

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের এ সময়ে এসে শ্রমিক ও শ্রমজীবী বলতেই কেমন জানি নীচু শ্রেণির মানুষকে বোঝায়।

পারস্পরিক সৌহার্দ সম্প্রীতি নেই আমাদের সমাজে। মূলত মানবিকগুণগুলো হারিয়ে আমরা যেন এক ভিন্ন সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছি। আজকের বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবী আর্থিক মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিরাট সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।

বর্তমানে একমাত্র আর্থিক সাচ্ছন্দ্যের ওপরই মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ভরশীল। নৈতিকতা বা মানবতার বিচারে সে যত জঘণ্য প্রকৃতিরই হোক না কেন,মোটা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকলেই সামাজিকতার সব উপকরণ তার করায়ত্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে বিত্তহীন ব্যক্তি বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার মাপকাঠি অনুযায়ী তার কোন মূল্যই নেই।

এর ফলে সাধারণ মানুষের সামাজিক মূল্য কতটুকু নিচু হয়ে যেতে পারে তার সুস্পষ্ট নিদর্শন আমরা বর্তমান সামাজিক পরিবেশে অহরহ দেখতে পাচ্ছি। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। ইসলামের দৃষ্টিতে আর্থিক সঙ্গতিই সমাজে স্থান লাভের উপায় নয় বরং প্রত্যেক সৎকর্মশীল ভালো ব্যক্তিই এতে মর্যাদার আসনে সমাসীন হবে।সে জন্মগত বা পেশাগত দিক থেকে যত নীচু মানেরই হোক না কেন,সে আপন কর্মের মাধ্যমে সমাজে স্বীয় মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পায়।

এই মৌলিক সত্যটির ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,তোমাদের মধ্যে তারাই বেশী মর্যাদাবান যারা অধিক আল্লাহ ভীরু ও পরহেজগার।(সূরা হুজুরাত,আয়াত১৩)।

ইসলাম তথাকথিত আভিজাত্যের ঠুনকো আবরনকে ভেঙ্গে দিয়েছে,আঘাত হেনেছে ভুয়া আভিজাত্যের ভিত্তিমূলে। এখানে বড় কথাই হলো, ‘মুমিন’ এরা ভাই ভাই। সামাজিকতায় কারো কোন প্রাধান্য নেই।

রাসূল (সা.)-এর স্পষ্ট ঘোষণা,আজমের ওপর আরবের,সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই। ইসলামের উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতিতে আমরা ইসলামের ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই যে,একজন সৎকর্মশীল পরহেজগার শ্রমজীবী হাজারো মিলিনিয়নার থেকেও উঁচু মর্যাদায় সমাসীন।

পেশায় শ্রমিক বলে এখানে তার মর্যাদাহানিকর কোনো পরিস্থিতি নেই। ইসলাম তার মর্যাদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষিত করেছে। একটি হাদিসে অধীনস্থদের মর্যাদার সার্বিক মূল্যায়ন করতে যেয়ে রাসুল স. ইরশাদ করেন,‘ইসলামের দৃষ্টিতে কেউই কোন কাওম-ই মানবতার উর্ধ্বে নয়। তার কাছে মনিব-চাকর,উঁচু-নীচু এবং গরিব ও আমীর সবাই সমান। কারও মধ্যে পার্থক্য নেই।

তবে ইসলামের দৃষ্টিতে একমাত্র পার্থক্যের কারণ হতে পারে তাকওয়া ও সৎকর্ম। এই যখন তোমাদের প্রকৃত অবস্থা,তখন কেন তোমরা অধীনস্থ লোকদের নিকৃষ্ট মনে কর? শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক সহ শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের যে অধিকার ও নাগরিক সুরক্ষা ইসলাম নিশ্চিত করেছে, একটি সমাজ সুস্থভাবে চলার ক্ষেত্রে সেগুলো অলঙনীয় মৌলিক মর্যাদা রাখে।

বর্তমান বাস্তবতায় ইসলামের শ্রমনীতি বিশ্ববাসীর পূণর্পাঠ প্রয়োজন। আজকে শ্রমিক অধিকারের জন্য দিবস পালন করা হয়,অথচ সে দিনও অনেক শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করা হয়না।

এভাবে শ্রমিক দিবস পালন করা শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। ইসলাম যে সমাজ ব্যবস্থার সন্ধান দেয়, তা শুধু কয়েকটি ক্ষেত্রেই নয়,বরং সার্বিকভাবে এর প্রত্যেকটি ধারা যদি কার্যকর হয়,তবে এমন এক সামাজিক পদ্বতির উদ্ভব হবে যাতে একদিকে সৃষ্টি হবে না অসংখ্য ধনকুবেরের অন্যদিকে সৃষ্টি হবে না লাঞ্ছিত,অসহায় ভূখানাঙ্গা শ্রেণির। তখন এমন একটি অভাবনীয় রকমের সামঞ্জস্যপূর্ণ মধ্যম অবস্থার জন্ম হবে যার প্রাচুর্য সকলেই ভোগ করবে।

আজকের এই সংঘাত বিক্ষুদ্ব পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ রাস্তায় চলতে হলে ইসলামী শ্রমনীতি গ্রহণ করতে হবে, এছাড়া কোন বিকল্প নেই।