একটি কবুলকৃত তাওবা

কবুলকৃত তাওবা

শায়খ মো: সাইফুল্লাহ : ‘তাওবা’ আরবি শব্দ, এর অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। ইসলামী পরিভাষায় তাওবা বলতে বুঝায়, আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা। নিজেকে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ নতজানু করা, অকপটে আল্লাহর কাছে নিজের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া।

কোরআন ও হাদিসে তাওবার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেঈদের অসংখ্য তাওবা নজির আমাদের সামনে বিদ্যমান রয়েছে। যাদের তাওবা আল্লাহ কবুল করেছেন বলে জানা যায়, তাঁদের মধ্যে অগ্রগামী সাহাবী হচ্ছেন হযরত মাইয আসলামী রা.।

মাইয আসলামী রা. এর তাওবার দৃষ্টান্ত হাদিসে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে- একদা তিনি রাসুল সা. এর কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! ‘আমি ব্যভিচার (যিনা) করেছি। নবি করিম সা. তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন তিনি অপরদিকে গিয়ে আবার বললেন, তিনি ব্যভিচার করেছেন। রাসুল সা. আবারও তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি আবার বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি ব্যভিচার করেছি, রাসুল মুখ ফিরিয়ে নিলেন। চতুর্থবার বলার পরে রাসুল তাঁর ব্যাপারে আদেশ জারি করলেন।

অত:পর তাকে হাররা প্রান্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং পাথর বর্ষণ শুরু করা হলো। যখন প্রস্তরাঘাতের তীব্রতা তাকে স্পর্শ করলো তখন তিনি দ্রতবেগে ছুটে পালাতে লাগলেন। তখন তিনি এমন এক ব্যক্তির মুখোমুখি হলেন, যার হাতে একটি উটের চোয়াল ছিল। সে ব্যক্তি তা দিয়েই তাকে আঘাত করলো এবং অন্যরাও তাকে প্রহার করতে লাগলো। এমনকি তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল। লোকেরা রাসুল সা. এর নিকট তাঁর কথা উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে না কেন?” (মিশকাত)। আবু দাউদের এক বর্ণনায় এ ঘটনার সেই উটের চোয়াল দিয়ে মোক্ষম আঘাতকারীর নামও এসেছে। সে ব্যক্তির নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবন উনায়স। সেই বর্ণনায় দয়াল নবির প্রতিক্রিয়াটি ব্যক্ত হয়েছে এভাবে- “তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে না কেন? হয়তো সে তাওবা করে নিতো এবং আল্লাহও তাঁর তাওবা কবুল করে নিতেন” (মিশকাত-৩৪২৪)।

বুখারীতে ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত এ প্রসঙ্গের বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সা. উক্ত ঘটনার স্বীকারোক্তিকারী মাইয আসলামীকে বলেছিলেন, “হয়তো তুমি তাকে চুমো খেয়েছো অথবা স্পর্শ করেছো অথবা তার দিকে তাকিয়ে দেখেছো?” আর এটাকেই গুরুতর পাপ বিবেচনায় ব্যভিচার বলে প্রকাশ করেছো (মিশকাত-৩৪০৪)।

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সা. লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওকি মদ্যপান করেছে? কিন্তু পরিক্ষা করে তাঁর মুখে মদের গন্ধ মেলেনি। তারপর রাসুলুল্লাহ সা. তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার মধ্যে পাগলামী আছে নাকি হে? তারপর জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি বিবাহিত? প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাবই তিনি এমনভাবে দিলেন যে, তাঁর পক্ষ সমর্থনের মতো আর কিছুই বাকী রইলো না”। মোটকথা তাকে তাঁর স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের সম্ভাব্য সকল সুযোগই রাসুল সা. দিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহর বান্দার মনে তাঁর মাওলা আল্লাহ তায়ালার ভয় এত বেশি পরিমাণে ক্রিয়া করেছিল যে, সেরুপ কোন সুযোগই তিনি গ্রহণ করেননি।

পরবর্তী সময়ে সাহাবীগণের কেউ কেউ যখন তিনি পরকালে মুক্তি পাবেন কিনা তা নিয়ে বাদানুবাদ করছিলেন, তখন রাসুল সা. বললেন, “সে এমনি তাওবা করেছে যে, যদি গোটা উম্মতের মধ্যে তাঁর সে তাওবাকে ভাগ করে দেয়া হয় তবে তা সকলেরই মুক্তির জন্যেই যথেষ্ট বিবেচিত হবে”(বুখারী,মুসলিম,আবু-দাউদ,তিরমিজি)।

মাইয আসলামী রা. এর তাওবা আল্লাহ কবুল করেছেন, রাসুল সা. তাঁর তাওবার ব্যাপারে ইতিবাচক স্বীকৃতি দিয়েছেন। কেননা তিনি কৃত অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য রাসুল সা. এর কাছে আসেন নি, কোন চলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ তিনি করেন নি, দুনিয়ার কোন সুযোগ তিনি নিতে চান নি। তিনি একনিষ্ঠভাবে, স্বপ্রণোদিত হয়ে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে কৃত অপরাধের তাড়নায় রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে ছুটে এসেছেন, শাস্তি দাবী করেছেন। ইসলামের ইতিহাসের সোনালী পাতায় তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে লিপিবদ্ধ সাহাবী মাইয আসলামী রা. এর তাওবা। আমাদের উচিত, কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে এভাবে ক্ষমা চাওয়া, নিজেকে নতজানু করে আল্লাহর দরবারে সোপর্দ করা, নিজের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি কামনা করা। তবেই নাজাত ও মাগফেরাতের মাসে আল্লাহ আমাদের জন্য ক্ষমার ফায়সালা করবেন, তাওবা কবুল করে নিবেন।
লেখক- এমফিল গবেষক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

আরো পড়ুন- বিনা কারণে রোজা না রাখার শাস্তি