আত্মশুদ্ধির মাসে নিয়তের পরিশুদ্ধতা

নিয়তের পরিশুদ্ধতা

শায়খ মো: সাইফুল্লাহ :  মাহে রমজান আত্মশুদ্ধির মাস, আত্মনিয়ন্ত্রণের মাস। নিজেকে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে সোপর্দ করার মাস। যে আয়াত দ্বারা রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, তার শেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উল্লেখ করে দিয়েছেন- “যাতে তোমরা আত্মসংযমের নীতি অবলম্বণ করতে পার”(বাকারা-১৮৩)।

এই আয়াতে আত্মার পরিশুদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, আর এটাই হচ্ছে মাহে রমজানের চূড়ান্ত শিক্ষা। এ শিক্ষা অর্জনের জন্য নিয়তের পরিশুদ্ধতা আবশ্যক। কেননা ইসলামে যেকোন ইবাদত ও কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদতের প্রতিদান পাওয়া যাবে না। তাই মুমিন জীবনে নিয়তের বিশুদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

রাসুল সা. বলেছেন, ‘মানুষ তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুনরুত্থিত হবে’। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ইখলাস এবং তাঁর সন্তুষ্টি কামনা ব্যতীত কোন আমল কবুল করবেন না’। ইমাম বুখারী তাঁর কিতাবের শুরুতে নিয়তের হাদিসটি নিয়ে এসেছেন। যাতে উল্লোখ করা হয়েছে- “যাবতীয় কর্ম নিয়ত/সংকল্পের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের জন্য তাই প্রাপ্য হবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যে ব্যক্তির হিজরত (স্বদেশত্যাগ) আল্লাহর (সন্তোষ লাভের) উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসুলের জন্য হবে; তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্যই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত তার সংকল্প অনুযায়ী গণ্য হবে”(সহীহ বুখারী, হা. ০১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩; মুসলিম-১৯০৭)।

আর নিয়ত হচ্ছে, মনের ইচ্ছা, অন্তরের সংকল্প; মনের অভ্যন্তরে উকি দেওয়া উদ্দেশ্য বা সংকল্প। নিয়তের জন্য কোন ধরনের শব্দ বা বাক্য নির্ধারণ করার হুকুম নেই। নিয়তের পরিশুদ্ধতা নিয়ত মূলত তাই, যা মানুষ নিজের অন্তরে ধারণ করে অথবা সংকল্প করে। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর আদেশ পালনার্থে কোন কাজের দিকে মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ও অভিপ্রায় প্রয়োগ। আল্লামা খাত্তাবী রহ. বলেন, ‘মনে কোন কাজ করার সদিচ্ছা পোষণ করা এবং তা বাস্তবায়নে প্রাণপন চেষ্টা করা।

নূরুল ইযাহ গ্রন্থকার বলেন, ‘কাজের উপর মনের ইচ্ছা পোষণ করাই নিয়ত’। আল্লামা বায়হাকি রহ. বলেন, ‘বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোন উপকার লাভ বা কোন ক্ষতির প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অনুকূল কাজ করার জন্য মনের উদ্যোগ উদ্ভাবন’।
মূলত ইবাদতে খুলুসিয়াত আনয়ন করাই নিয়ত আবশ্যক হওয়ার মূল কারণ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা আছে- ‘আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে (নিয়তের পরিশুদ্ধতার সাথে) আল্লাহর দ্বীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে’ (সুরা বাকারা)। “এসব নামাজীদের জন্য ধ্বংস যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে বেখেয়াল।

আর যারা লোক দেখানো কাজ করে’(সুরা মাউন)। “তারা শুধু এজন্য আদিষ্ট হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যে অকৃত্রিম করে একনিষ্ঠভাবে তার নামাজের পাবন্দী করে এবং যাকাত আদায় করে। আর এটিই সেই বর্ণিত সঠিক পন্থা’(সুরা আল-বাইয়্যেনাহ)। নিয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে আরো একটি প্রাসঙ্গিক হাদিস রয়েছে। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারার রুপ সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের দিকে লক্ষ্য করবেন না। বরং তিনি তোমাদের অন্তরের নিয়ত ও আমল দেখবেন।

নিয়ত বিষয়ে আমাদের জন্য লক্ষণীয় যে- ০১. সকল ইবাদতে নিয়ত করা ওয়াজিব। ০২. সাওয়াব অর্জন নিয়তের উপর নির্ভরশীল। এজন্য ওলামাগণ মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন- নিয়ত ছাড়া কোন সাওয়াব নেই। ০৩. সৎ নিয়তের মাধ্যমে অভ্যাস সমূহ ইবাদতে পরিনত করা যায়। যেমন: গোসল, ঘুম, পানাহার ইত্যাদি। ০৪. যে কোন কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। কোন আমলের শুরুতে নিজের নিয়তকে শুদ্ধ করে নেওয়া। উদ্দেশ্য একাধিক থাকলেও নিয়ত হতে হবে পরিশুদ্ধ। যেমন কেউ নিকট আত্মীয়কে দান করে আত্মীয়তার হক আদায়ের পাশাপাশি সাওয়াবের উদ্দেশ্য রাখলো। এক্ষেত্রে দুটোর নিয়তই আল্লাহ পাককে সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। ০৫. খারাপ কাজের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের নিয়ত করা কুফরি। যেমন, চুরি,ডাকাতি, ঘুষের অর্থ গরিব নি:স্বদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে সওয়াবের আশা করা। ০৬. মানবতার কল্যাণের জন্য বহু লোক নিয়তের শুদ্ধ রেখেও মানুষের আনুগত্য করে তাকে খোদায়ী আসনে বসিয়ে দেয়। এরুপ ভালো কর্মের কোন মূল্য নেই। ০৭. ভালো নিয়তে বিষ হজম করলে মানুষের মৃত্যু যেমন স্বাভাবিক, তেমনি ভালো নিয়তে কুফরি কথা ও কাজের সঙ্গ দিলে ঈমান হারা হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত।

আত্মশুদ্ধির মাসে সকল কাজে ও ইবাদতে নিয়তের পরিশুদ্ধতার চর্চা করতে পারলে ইবাদত কবুলের ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রা যোগ হবে। তাই, আত্মার পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি নিয়তের পরিশুদ্ধতা আনয়ন জরুরী।

লেখক- এমফিল গবেষক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট