মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরী থেকে – এ কে এম বজলুর রহমান

মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরী

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে শেষ দেখা ২৫ মার্চ রাতেই; তাঁর ধানমন্ডির বাসায়। আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম আপনি কি করবেন? তিনি বলেছিলেন, আমি বাসায় থাকবো। আমার পক্ষে এখন আত্মগোপনে যাওয়া সম্ভব না। তবে তোরা কেউ ধরা দিবি না। সেনাবাহিনী আমাকে কিছু করতে সাহস পাবে না।

নেতার নির্দেশ মোতাবেক আমরা ঢাকা থেকে দ্রুত নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। এরপর শীতলক্ষ্যার অপর পাড়ে মদনগঞ্জের একটি চাউলের কলের গুদামে সারা রাত কাটালাম। সারা রাত কারো ঘুম হল না। খাওয়া দাওয়ার কথাও মনে হল না। একটা দারুণ উৎকন্ঠার মধ্যে রাত কাটল। কালো রাত যেন কাটতে চায় না, ভোরে পূর্বাকাশে লাল সূর্যের উদয় লগ্নে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে চারদিক থেকে আওয়াজ আসতে লাগলো ‘জয় বাংলা’ ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ আমাদের শরীরে রক্ত যেন টগবগিয়ে উঠলো জনতার মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য। আমি আর আনসার চলে যাই শহরতলীর গোগনগর ইউনিয়নের শহীদনগর গ্রামে। প্রায় ১০ হাজার গ্রামবাসীকে দা বল্লম বাঁশের  লাঠি সড়কি ইত্যাদি অস্ত্রসহ এক জঙ্গী মিছিল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর প্রদক্ষিণ করি।

মুক্তিযুদ্ধের
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বজলুর রহমান। ছবি-সংগৃহীত

একদিকে আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, অন্যদিকে ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনী এগুচ্ছে নারায়ণগঞ্জের দিকে। খবর পেলাম ফতুল্লা পর্যন্ত তারা এসে গেছে। নারায়ণগঞ্জের বীর সন্তান ছাত্রলীগ ও আওয়ামী কর্মীরা আনসার কয়েকজন পুলিশসহ গোরস্থানে রাইফেল ও বন্দুক নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের অফিসে কন্ট্রোলরুমে আমি জোহা সাহেব, খোকা মহিউদ্দিন, আফজাল, নিলু মল্লিক আরও অনেক কর্মীসহ বসে আছি। টেলিফোনে মিনিটে মিনিটে ঢাকার খবর নিচ্ছি। কিন্তু ২৫ মার্চ গভীর রাতেই ঢাকার সাথে টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিছুই আর বুঝতে বাকি রইল না। নিরস্ত্র জনতার উপর হানাদার বাহিনী নির্বিচারে আক্রমণ চালাচ্ছে। ঢাকার অদূরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী দূর্গ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে আক্রমণে সম্ভাবনা প্রবল। হঠাৎ করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বড় রাস্তার উপর কন্ট্রোলরুমে কেউ থাকব না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সারা শহরে রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড সৃষ্টি হয়ে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের
১৯৭১ সালের ১৩ জুলাই এ কে এম বজলুর রহমানকে চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি-সংগৃহীত

তিনদিন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের বীর মুক্তিসেনারা পাকবাহিনীকে নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতে দেয়নি। অবশেষে ট্যাংক নিয়ে শত্রুসেনারা নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।  তিনদিন আমার পরিবারের কোন খোঁজ নিতে পারিনি। দিনরাত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিছিল করেছি। ২৭শে মার্চ ডন চেম্বারের ১০০ নং আমার বাসায় গিয়ে দেখি বাসায় গুলি পড়েছে। পাশের বাসায় একজন গুলিতে মারা গেছে।

সবাই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে।  কেবল জানটুকু নিয়ে আমিও ছেলেদের নিয়ে চলে গেলাম শীতলক্ষ্যার অপর তীরে নবীগঞ্জে এক পাটের গুদামে। কিন্তু সেখানেও নিরাপদ মনে হল না। তাই জনতার সাথে হাঁটা দিলাম। নিরুদ্দেশের পথে, সাথে কেবল একটা সুটকেস ও যার যার পরনে যা কাপড় ছিল তাই। আমার এক ভাই মকবুল হোসেন ৮টি ছেলে এবং আমি ও আমার স্ত্রী হাঁটতে হাঁটতে মদনপুর আঃ ছাত্তার ভূইয়ার বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।

হাজার হাজার লোক উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে প্রাণ ভয়ে। গ্রামবাসিরা পথে পথে খাবার দাবার ও খাবারের পানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি এ অদ্ভুত দৃশ্য। মানুষের প্রতি মানুষের মানবতার দরদী জীবনে এমনটি আর কখনও দেখি নাই। আঃ ছাত্তার ভূইয়ার ও আমি হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণের কাহিনী শুনে আমরা দুই জনে স্থির করলাম হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিরস্ত্র বাঙালী জাতিকে বাঁচতে হলে কোন বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্য দরকার।

সিদ্ধান্ত নেয়া হল খুব ভোরে আমরা দু’জনে আগরতলায় চলে যাব। কাউকে জানাবো না। এমনকি স্ত্রীদেরও না। আট মাসের ছোট ছেলে জুয়েলকে বুকে নিয়ে একটু চুমো খেলাম। স্ত্রীকে বললাম আমার ভাইয়ের সাথে রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি চলে যাও, আমার কাজ আছে। দুই একদিন পর আসবো। মনে মনে বললাম হয়ত আর জীবনে দেখা নাও হতে পারে। কারণ পণ করেছি মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। হয় স্বাধীনতা আনব নইলে জীবনে আর দেখা হবে না।

মুক্তিযুদ্ধের
স্বাধীন বাংলাদেশ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীকে সালাম দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এ কে এম বজলুর রহমান

সেদিন দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম। তা না হলে স্ত্রী-ছেলে সংসার আত্মীয় স্বজন এসব ভোলা কি এতই সহজ? স্ত্রীর কাছে এই সংকল্পের কথা গোপন করলেও আগরতলা থেকে একটা চিঠি লিখেছিলাম স্ত্রীকে। লিখেছিলাম, প্রেয়সী অপরাধ নিও না। তোমাদেরকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসি। কিন্তু তার চাইতেই ভালবাসি দেশমাতৃকা। মায়ের হাতে পায়ে পরাধীনতার শৃংখলা তাকে মুক্ত না করতে পারলে আমার জীবন বৃথা। যদি দেশকে স্বাধীন করে বীরের মত আসতে পারি তবেই দেখা হবে। নতুবা আর দেখা হবে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির যে অবস্থা হবে তোমাদেরও সেই অবস্থাই হবে। যদি হানাদার বাহিনী তোমার ইজ্জতের উপর আক্রমণ করে তবে বিষপানে আত্মহত্যা করবে।

মুক্তিযুদ্ধের

আবদুস ছাত্তার ভূইয়া ও আমি লাঙ্গলবন্দের কাজী সাহেব ও অন্য একজন হিন্দুকে সাথে নিলাম পথ প্রদর্শক হিসেবে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে দাউদকান্দি যাই। সেখান থেকে কিছুটা রিক্সায় কিছুটা পায়ে হেঁটে চান্দিনা বাজার পর্যন্ত। বিকাল ৫টায় চান্দিনা থেকে ৫০ টাকা দিয়ে দুইখানা রিক্সা করে বরুড়ার পথে রওয়ানা দেই। অনেকেই বাধা দিল। কারণ তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ও ময়নামতিতে বাঙ্গালি অবাঙ্গালি সৈনিকদের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। অনেক বাঙ্গালিকে মেরে ফেলেছে। কিছু কিছু বাঙ্গালি সৈন্য সিভিল পোশাকে পালিয়ে এসেছে। রাস্তায় তাদের সাথে দেখা হল। আমাদের মাথার উপর দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলিও চলে গেল। এবাবে গুলিগোলার ভিতরে দিয়ে রাত ৮টায় বরুড়া বাজারে যাই। সেখানে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীর বাড়ীতে রাত কাটাই। ২রা এপ্রিল খুব ভোরে সীমান্ত পার হয় সোনাইমুরী দিয়ে আমরা আগরতলায় পৌঁছাই।

বিকাল ৫টায় আমরা আগরতলায় পৌঁছলে হাজার হাজার লোক আমাদেরকে ঘিরে ধরে বাংলাদেশের খবর জানার জন্য। অনেকেই আমাদেরকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইল। আমরা গেলাম না। দৈনিক দুই টাকা ভাড়ায় রিটজ হোটেলে দু’খানা রুম আমরা নিলাম। রাত ৮টায় চললাম আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী বাবু শচীন সিংয়ের সাথে দেখা করতে। সেখানে দেখা হল চট্টগ্রামের জহুর আহাম্মদ চৌধুরী, মোঃ হারুন, এম আর সিদ্দিকী ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সাথে।

শচীন সিং আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, আমার এই ঘর ছেড়ে দিলাম আপনাদের থাকার জন্য। আপনাদের পায়ের ধুলি আমার ঘরে দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন। আপনারা বাঙ্গালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম কাতারের সেনানী। আপনারা যা বলবেন আমি তাই করব। আপনারা এখানে বসুন, পরামর্শ করুন কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের শুরু করা যায়। শত শত যুবক যুবতী উদ্বাস্ত হিসাবে আসছে তাদেরকে কিভাবে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া যায়। আমরা আগরতলায় তখন পুলিশ ক্যাম্পে আছি অস্থায়ীভাবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল একটা অফিস করতে হবে যাতে করে সেখান থেকে লাখ লাখ আগমনকারী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে সাহায্য করা যায়। আগরতলা রাজবাড়ীসহ সমস্ত স্কুল কলেজ অফিস আদালত বাংলাদেশী হিন্দু মুসলিম উদ্বাস্তুতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল।

মুক্তিযুদ্ধের

এই সমস্ত ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য প্রয়োজন বোধে আগামীকালই আপনাদেরসহ নয়াদিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতে চাই। আপনারা সিদ্ধান্ত নেন। আমরা একটা পরামর্শ সভায় বসলাম এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তও নেওয়া হল। আমরা কয়জন দিল্লী যাব ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতে এবং তাঁর পরামর্শ নিতে। আমরা একটা খসড়া প্রবাসী বাংলাদেশ ডঃ রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুজ্জামান ঢাকা থেকে পাগলের বেশে আগরতলায় গিয়ে উপস্থিত। পাঁচ মিনিট সভায় সকলে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম নবাগত দুইজনকে প্রতিনিধি দলে দিল্লী প্রেরণ করা হবে। আমি ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর স্বেচ্ছায় বাদ পড়ে গেলাম। কারণ ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থ তখন সব চেয়ে বড় ছিল। দুই জন বাঙ্গালি বিখ্যাত প-িতকে দিল্লী পাঠানো আমাদের আশু কর্তব্য ছিল। সেই দিন বেলা ১০টায় প্রবাসী মন্ত্রিসভার তালিকাসহ জনাব এম আর সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল দিল্লী চলে যান। দিল্লীর প্রতিনিধি দলের সাথে সৌভাগ্যক্রমে জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গেল। সেই প্রতিনিধিরা তাজউদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একটি তালিকা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের

মন্ত্রীসভা গঠন করার তিন দিন পরই তাজউদ্দিন সাহেব আগরতলায় চলে আসেন। একই দিনে খন্দকার মোশতাক আহম্মদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামও আগরতলায় চলে আসলেন। আমার কাছে তখন এম আর সিদ্দিকী সাহেব ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন অফিসের কিছু কাগজপত্র ক্রয় করার জন্য। এই কয়েক দিন আমরা ২৫ জনের খাবারও আগরতলার সরকার সরবরাহ করতো। পরে তাদের সরকারী খরচে আমরা নিজের ব্যবস্থা করতাম। ২৫ জনের খাবার আমরা ৫০/৬০ জনেও কোন কোন দিন ভাগ করে খেতাম। কাকে কাকে খাবার দেওয়া হবে সেই স্লিপ দেওয়ার দায়িত্বে  ছিলাম আমি। আমার লেখা পারমিশন ছাড়া কাকেও ভাত দেওয়া হত না।কেবল ডাল ভাত আর একটু তরকারী এই ছিল আমাদের সাধারণ খাবার।

সেসময় রিসিপশন ক্যাম্প থেকে ভালো ভালো যুবকদেরকে গেরিলা ট্রেনিং দেওয়ার দ্য ইয়ুথ ট্রেনিং সেন্টার-এ নিয়ে যাওয়া। প্রায় ৪০টি রিলিফ ক্যাম্প, ২০টি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প ও ১৭টি ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। প্রত্যেকটি রিসিপশন ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্প আমার হাতে গড়া। প্রত্যেক ক্যাম্প-এর বিছানা বাসন পাকের সামগ্রী চাল ডাউল তরিতরকারী সব আমাকে যোগাড় করতে হত। অবশ্য আমার কয়েকজন সহকারী ছিল তারাও খুব কাজ করেছে।

দীর্ঘ ৬ মাস এভাবে চলছিল। অবশেষে একটা কেন্দ্রীয় ইয়ুথ ক্যাম্প ডাইরেক্টরেট করা হয়েছিল কলকাতা থেকে। আমাকে সেখানে করা হয়েছিল ডাইরেক্টর অফ ইয়ুথ মুভমেন্ট। যখনই কোন রিসিপশন ক্যাম্প থেকে অন্য কোন ট্রেনিং ক্যাম্প-এ যুবকদেরকে পাঠাবার প্রয়োজন হত তখনই আমাকে ডাকা হত। কারণ ট্রান্সপোর্ট যোগাড় করতে হবে। আগরতলায় লোকজনের সাথে আমার এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমি ফোন করে দিলেই বিনা পয়সায় যত ট্রাক বাস দরকার পাঠিয়ে দিত। দৈনিক আমি প্রায় দুইশত ট্রাক বাস ভাড়া করতাম বিভিন্ন ক্যাম্প-এ যুবকদের প্রেরণ করবার জন্য ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত যুবকদের বাংলাদেশের সীমান্তে অস্ত্রশস্ত্রসহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

বাংলাদেশের ভেতর থেকে ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা আগরতলা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই টাকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের আমাকে একনাগাড়ে ১৫ দিন গুনতে হয়েছে। ২০টি ট্রাঙ্ক খরিদ করে আগরতলায় ইন্টারন্যাশনাল স্টেট ব্যাংক-এর লকারে অতি সঙ্গোপনে রাখা হয়েছিল সে টাকা। লকারের চাবি আমার কাছেই থাকত। আমাদের দুই জনের যুক্ত স্বাক্ষরে টাকা উঠানো হোত।

এক একটা ট্রাংকে ৫০/৬০ লাখ করে টাকা ভর্তি ছিল। টাকার বোঝা কতটা অস্বস্তিকর তখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কোটি টাকার স্তূপের উপর অস্বস্তিতে অনেক দিন রাত কাটিয়েছি। আমার বন্ধুরা অনেক কিছুই রটনা করে দিলেন। আমি নাকি কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে ফেলেছি। কিন্তু আলম সাহেব ও এম আর সিদ্দিকী সাহেব কারও কথা বিশ্বাস করেননি। কারণ তারা আমার বিশ্বস্ততার প্রমাণ পেয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিল,  ১০ হাজার টাকা নিয়ে নরসিংদী চলে যাও। তোমার স্ত্রী পুত্রদেরকে আগরতলায় নিয়ে আসো। আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। বলেছিলাম, দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরব না। আমাকে পকেট খরচ হিসাবে প্রতি মাসে দুইশত টাকা দিলেই চলবে। টাকার লোভ তখন ছিল না। যদি থাকত তবে আজ আর না খেয়ে মরি না। বাড়ী নাই, ঘর নাই, ছেলেদের শিক্ষা দিতে পারি না। নিজের চিকিৎসা করাতে পারি না। রীতিমত খাবারই পাই না।

ব্যস্ততা কারণে অনেকেই সাথে ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না। আমি বৃষ্টিবাদলের মধ্যে জঙ্গলে জঙ্গলে থাকতাম। জিপ গাড়ীতেই ঘুমাতাম ও থাকতাম সারাদিন সারা রাত। আমি এখন নিজেই অবাক হয়ে যাই তখন এত উৎসাহ উদ্দীপনা কোথা থেকে পেয়েছিলাম? এখন মনে হলে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না কিভাবে আমার ভাঙ্গা স্বাস্থ্য নিয়ে আগরতলায় দিন রাত কাজ করেছি। দুনিয়াতে যে বেশী কাজ করবে তার বেশী শত্রু হবে। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা। আগরতলায় আমার তাই হল। দেশের জন্য বেশী কাজ করতে গিয়ে অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেলাম।

অবশেষে ঠিক করলাম নিজে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ব। যুদ্ধ করতে। জহুর আহম্মদ চৌধুরী তখন আগরতলা জোনের প্রধান। তাকে অনুরোধ করে ২৫ জন আওয়ামী লীগের কর্মীদের একটা বিশেষ গ্রুপ করে আগরতলার পাশে লেন্বুছড়া ক্যাম্পে কে, পি, সিং-এর নেতৃত্বে এডভান্স গেরিলা ক্যাম্পে চলে গেলাম। ১৫ দিনের ট্রেনিং-এ আমি রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান ও অন্যান্য যুদ্ধের প্রয়োজনে অস্ত্র শস্ত্র ভাল জ্ঞান লাভ করলাম। কে, পি, সিং আমাকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন করে দিলেন।

ইতোমধ্যে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলেছে। পাক বাহিনী সমানে আগরতলায় দিনরাত শেল মারতে আরম্ভ করেছে। আমরা দিনরাত অধিকাংশ সময় ট্যাংকারের ভিতর সময় কাটাতাম। সেখানেই খাওয়া দাওয়া দেওয়া হত। রাতেও প্রায়ই সেখানে থাকতাম। ইয়ুথ ক্যাম্পগুলি পাকবাহিনীর টার্গেট ছিল। তাই সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে যেত সমস্ত এলাকা। আমরা সতর্ক থাকতাম শত্রুপক্ষে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে। দুইরাত আমার ডিউটি পড়েছিল মর্টারগানের। আকাশের দিকে তাক করে শত্রু বিমানের আক্রমণের আশংকায় ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতাম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে। এই মুহুর্তগুলিই আমার জীবনের সবচেয়ে দূর্লভ মুহুর্ত। আমাদের ক্যাম্প লিডার কে পি সিং আমার প্রতি আস্থার কারণে এতবড় দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মাতৃভূমিকে উদ্ধার করার সংকল্প নিয়ে আমি যে আগরতলায় গিয়েছিলাম মে পি সিং তা জানতেন এবং জানতেন বলেই আমাকে এতবড় দায়িত্বে নিয়োগ করেছিলেন।

১৬ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ঢাকাতে আত্মসমর্পণ করল। মিত্র বাহিনীর নিকট। আমাকে কলকাতায় যেতে হল সমস্ত হিসাব পত্র বুঝিয়ে দিতে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সাথে দেখা করে আবার আগরতলা হয়ে তবে দেশে ফিরতে হল।

মুক্তিযুদ্ধের পর দেখি অনেকেই দেশের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। টাকার পেছনে ছুটছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন হওয়া উচিত না। ধন সম্পদ কয় দিনের? আজকে যদি মরে যাই তবে বলতে হবে একজন নিঃস্বার্থ অসহায় নিঃসন্বল রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আজকের দিনে এটাই প্রয়োজন। আমি মনে করি আমার রাজনৈতিক জীবন ব্যর্থ হয় নাই। মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে জয়যুক্ত হয়েছি। আর কি চাই? ব্যক্তিগত আরাম আয়াশ করতে হলে অনেক রাস্তাই খোলা ছিল। সেই পথ আমার জন্য নয় আমার জীবন ধন্য।

আমি সম্পদের পাহাড় গড়ে গেলেও আমার ছেলেরা হয়ত অপকর্ম করে অপবাদ অর্জন করত। একজন নিঃস্ব সর্বহারা রাজনৈতিক কর্মীর সন্তান হিসাবে সমাজ নিশ্চয়ই একদিন আমার ছেলেদেরকে সম্মান দেবে যদি তারা সততা ও চরিত্র বজায় রাখতে পারে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জয়যুক্ত হওয়ার পর জীবনে আর কোন সাধ থাকা উচিত নয়। ধন-সম্পদ, ক্ষমতা প্রতিপত্তি সবই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এতো বড় বিজয় জীবনের কোন ক্ষেত্রে আর হবে না। যা ইতিহাস থেকে কোন দিন মোছা যাবে না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আমাদের নাম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে লেখা থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধেরলেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : এ কে এম বজলুর রহমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক, ভাষা সৈনিক, সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কখনও নির্বাচনমুখী রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত কর্মি হিসেবে তৃণমূলের রাজনীতি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনিই প্রথম রণাঙ্গনে যোগ দেন। ইয়ুব ক্যাম্পের ডাইরেক্টর মুভমেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই লেখাটি তার জীবদ্দশায় নিজের হাতে লিখতে শুরু করেছিলেন। সমাপ্ত করতে পারেননি। ১৯৮৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী ৫৮ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

আরো পড়ুন- হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৪১টি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ